পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/৪৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধরাবাঁধা জীবন 8、 আয়োজন করিতে হইবে না। এখন শুধু আছে চাওয়া এবং পাওয়া। তাছাড়া সমস্তই বাহুল্য, অনাবশ্যক। দুজনের মধ্যে সব ব্যবধান সংক্ষিপ্ত হইয়া গিয়াছে। চারিদিকে ছড়ানো দিগন্তের যেদিকে খুশি মুখ করিয়া রওনা হওয়া, কাছে আসা আর দূরে যাওয়া, পথ ভোলা আর পথ খোজা, নদী মাঠ বন উপবন সাগর ও পাহাড় পার হওয়া, এ সবের আব্ব প্রয়োজন নাই, তার আর প্রভাব মধ্যে সোজা লাইন পাতা হইয়া গিয়াছে। ভূপেন ভাবিতেও পারে নাই, এত সব রোমাঞ্চকর সম্ভাবনার এমন ভেঁাতা। পরিণতি হইবে। তার জানাও ছিল না প্রেম বাড়ে কমে, কঁাচে মবে। সেদিন প্রভার কাছে বিদায় লইযা চলিয়া আসিবার সময়ও সে কিছু টের পায় নাই। একটা গুরুতর জটিল সমস্যার অতি সহজ ও সুন্দর মীমাংসা হইয়া গিয়াছে ভাবিয়া তখন কেবল নিশ্চিন্ত হওয়ার শান্তিই সে অনুভব করিয়াছিল। সেই সঙ্গে ছিল প্রভার সঙ্গে সমস্ত বিরোধের অবসান ও সর্বাঙ্গীণ বুঝাপড়ার আনন্দ। শাস্ত মধুর এক অনির্বাচনীয় পুলকেব মধ্যে কয়েকটা দিন তার কাটিয়া গিয়াছিল, মনে হইয়াছিল পৃথিবী কী সুন্দর, গৃহ কী মনোরম, বাঁচিয়া থাকা কী সুখের। তারপব শীতল জলে স্নানের প্রভাবের মতো কীভাবে যেন উবিয়া যাইতে লাগিল সেই অস্থায়ী আবেশ, ধীরে ধীরে মিথ্যা হইয়া যাইতে লাগিল সাময়িক সত্য। রসালো দিনগুলি হইয়া উঠিল। নীরস দীর্ঘ সময়। পাখা মেলিয়া উড়িতে উড়িতে এক সময় তার আকাশটি পর্যন্ত রহিল না, পাখা গুটিাইয়া ভারাক্রান্ত দেহে অবসন্ন মনে নামিয়া আসিতে হইল পাথব ঢাকা মাটির প্রলেপ বিছানো কাকরে । ভূপেনের মানসিক স্থবিরত্বেৰ সুযোগে সংসাব ধীরে ধীরে তার মনোযোগ নিজের দিকে টানিয়া লাইতে লাগিল। এতদিন সংসাবের কোনো বিষযে কেউ কিছু বলিতে আসিলেই ভূপেন বিরক্ত হইয়া উঠিতেছিল, এখন ছোটোেবড়ো সব বিষয়েই তার পরামর্শ ও নির্দেশ পাওয়া যাইতে লাগিল। স্বর্ণের সাহস সকলের চেয়ে বেশি, সংসার পরিচালনার দাযিত্বটাও তার, ভয়ে ভয়ে সেই প্ৰথমে দুটি-একটি সমস্যা তার দপ্তরে হাজির করিতে লাগিল! তারপর জানাজানি হইয়া গেল মেজাজ ভূপেনের ঠান্ডা হইয়া গিয়াছে, কথায্য কথায় অকারণে সে আর চটিয়া উঠে না। তখন সাহস পাইয়া সকলে ঘোষিয়া আসিল তার কাছে, জানাইতে লাগিল অসংখ্য দাবি ও প্রার্থনা ! ভীবু রমলা পর্যন্ত স্বর্ণের রায়ের বিরুদ্ধে তার কাছে আপিল পেশ করিতে গেল, তার গান শেখার বিশেষ ব্যবস্থা করিয়া না দিলে সে কিন্তু প্রয়োপবেশন আরম্ভ করিবে, হাঁ। বাঁধভাঙা বন্যার মতো স্থগিত কবা দায়িত্ব ও কর্তব” ভূপেনকে ভাসাইয়া নেওয়ার উপক্ৰম করিল। কত কী যে তাকে কবিতে হইবে তার ঠিক ঠিকানা নাই। পিসির বড়ো মেয়েটাব বিবাহ না দিলে নয়, পুবী যাওয়ার জন্য মা উতলা হইয়া পড়িয়াছেন, নৃপেন ম্যাট্রিক পাশ করি যা এবার কোন কলেজে কী পড়িবে ঠিক করা দরকার, বিমলার ফিটের অসুখের বাড়াবাড়ি শুরু হইযাছে, ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত, বাড়ির প্রায় সকলের জন্য জামাকাপড় কিনিতে এ মাসে বেশি টাকার দরকার, দু-বছর বাড়ির কলি ফিরানো হয় নাই, মন্টুর গায়ে ফোড়া উঠিয়াছে, খুকি। সর্বদা নখ কামড়ায়, আরও কত কী। আগে এ সব সরমার মারফতে তার কাছে পৌঁছি ত এতটুকু ব্যস্ততা বা উদবেগ সরমার দেখা যাইত না, ধীরে-সুস্থে একে-একে সমস্ত দরকারি-অ-দরকাবি খববগুলি তাকে শুনাইয়া যাইত, যেখানে ব্যাখ্যা প্রয়োজন নিজেই ব্যাখ্যা করিত। কোন বিষয়ের গুরুত্ব কতখানি নিজে নিজে স্থির করিবার কী আশ্চর্য ক্ষমতা সরমার ছিল ! শুধু তার বলিবার ধরনেই সব বিষয়ে ভূপেনেরও স্পষ্ট ধারণা জন্মিয়া যাইত, মনে হইত কিছু না বলিয়াও সরমাই যেন তাকে বলিয়া দিয়াছে কোন বিষয়ে কী তার কী করা উচিত। এখন সোজাসুজি সংসারের বহুমুখী জটিলতার সংস্পর্শে আসিয়া মাঝে মাঝে ভূপেনের ধাঁধা লাগিয়া যায়, নিজেকে অসহায় মনে হয়। সারমার জন্য তখন মন কেমন করিতে থাকে। সরমা