পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ο δ Ο মানিক রচনাসমগ্র ইন্দু সলজে একটু হাসিল। ভালো, না ছাঁই ! কী লজ্জাতেই ফেলিয়াছিল কাল ? আড়িপাতার ব্যাপার জানে না কোন দেশের মানুষ ও ? ক্ষেস্তি বলিল, হাসিস কি লো ? ও বাড়ির পুষি বেড়ালটার পর্যস্ত যখন মন জুগিয়ে চলতে হবে তখন টের পাবি। এবার অবশ্য তেমন ভাবনা নেই, যে কটা দিন থাকিস বয়েস আর বৃপের সমালোচনা শূনে আর যে যা করতে বলে করে ঘরের মেযে ঘরে ফিরে আসবি। ঠ্যােলা বুঝবি পরের বার। কেউ আপন করবার চেষ্টাটুকুও করবে না-এক বর ছাড়া, তা বরও যে খুব বেশি চেষ্টা করবে মনেও করিস না-নিজে নিজে তোকে সকলের আপনি হতে হবে! বাকবা, সে এক তপস্যা। লোক যদি ওরা মোটামুটি ভালো হয় তা হলে বছর খানেকের তপস্যাতেই এক রকম ঠিক হয়ে আসে, পান থেকে খসা চুনটুকু নিয়ে আর কেলেঙ্কারি কাণ্ড বেধে যায় না, গরম মেজাজি কেউ থাকলেই চিত্তির !! একটা ফ্যাকড়া যদি বাধে আর কী, রইল তা চিরস্থায়ী হয়ে, দোষ সে তোমাবাই হােক আর যারই হােক ! আমার মেজো ননদ ? কী রাগ বাবা, তাওয়ার মতো তেতেই আছে ! আমাকে গাল না দিয়ে আজও কি সে জল খায় ? খায় না ! শাশুড়ি মাগি লোক মন্দ নয়। তাই রক্ষা, নইলে গিয়েছিলাম। আর কী ! মেজো ননদের সঙ্গে কবে কী তুচ্ছ ব্যাপাব নিয়া খুঁটিনাটি বাধিয়াছিল, ক্ষেস্তি তাহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দাখিল করিল ; শেষে বলিল, তা শোন, পরেব বার যখন যাবি একটা কথা মনে রাখিস যে, ভোর পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত যত মুখ বুজে খাটবি সবাই তত ভালো বলবে, আর রাত জেগে বরের সঙ্গে যত গুজগাজ ফিসফাস করতে পারবি বর তত খুশি থাকবে। বলিযা ক্ষেস্তি হাসিল। ইন্দু মৃদুস্বরে বলিল, শেষেরটাতেই ভয় ভাই। যে ঘুমকাতুরে আমি জানিস তো। ঘুম আর চোখে থাকবে না লো, থাকবে না, বরঞ্চ মনে হবে, পোড়া বিধাতার কী বিবেচনা মরে যাই, এত ছোটাে করেছে। রাত, তার উপর আবার ঘুমের ব্যবস্থা ! ঘটনার ঘনঘটায় ইন্দুর মন উদভ্ৰান্ত হইয়াছিল, সখীর পবিহাসে সে অল্প একটু হাসিল বটে, কিন্তু কৌতুক অনুভব করিল আবও কম। হরেন (ইন্দুর বরেব নাম ; মানুষটার চেয়ে নামটির সঙ্গেই ইন্দুর পরিচয় বেশিদিনের ; নাম ও নামীকে সে এখনও একত্র জড়াইয়া ভাবে ) অনেকক্ষণ খাইতে বসিয়াছে, নতুন জামাইয়ের খাইতে সময় লাগে, কিন্তু সে আর কতক্ষণ, হারেনের খাওয়া হইলেই या ! অজানা অচেনা মানুষের সঙ্গে সেই তালশিমুলির উদ্দেশে যাত্রা, সেখানে যাইতে হইলে তেরো মাইল পালকিতে গিয়া স্টিমার ধরিতে হয় ; রাত দশটায় সে স্টিমার কোন সিন্টমার ঘাটে নামাইয়া দেয় কে জানে, তারপর রাত বারোটা অবধি পাড়ি জমাইতে হয় নীেকায়। মালপতি হইতে তালশিমুলি অনেক দূর-এতই দূর যে ব্যবধানটা ইন্দুর মনে দিকহীন রাইঘোষাণির মাঠের মতো ধুধু করিতে থাকে-বৈশাখের খররৌদ্রে যে মাঠের তৃণগুলি ঝলসাইয়া গিয়াছে, এখন যাহার দিকে তাকাইলে আগুনের হালকায় দুচোখ টনটন করিবে। রাইঘোষাণির মাঠ ঘোষিয়া স্টিমার ঘাটের পথটা অনেক দূর অবধি সিধা চলিয়া গিয়াছে, তারপর ডাইনে বঁকিয়া ঢুকিয়া পড়িয়াছে সাতগাঁয়ে। ওই গ্রামে স্বরূপ চক্ৰবতীর বাড়ি। স্বরূপ চক্ৰবতীর ছেলের সঙ্গে ইন্দুর সম্বন্ধ হইতেছিল, কেন ভাঙিয়া গেল কে জানে ! ওখানে বিবাহ হইলে একদিক দিয়া ভালেই হইত ইন্দুর। যখন-তখন সে বাপের বাড়ি আসিতে পারিত, সোমবারে পারিত, স্বরূপ চক্ৰবতীর বাড়ির পিছনের ধান খেতটা পার হইয়া আসিয়া দাঁড়াইলে মালপতির গাছপালা তাহার চােখে পড়িত ; সবচেয়ে উঁচু তালগাছটার নীচেই তাঁহাদের এই বাড়ি। ছেলে কালো তো কী হইয়াছে ? বরের রং ধুইয়া সে কি জল খাইত ?