পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/২১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাগৈতিহাসিক SS (? জীবনের যে মানে সে খোঁজে তাহা অসাধারণ বৈচিত্ৰ্য, উত্তেজনা, ভূমিকম্প, রোগশোক ও আতঙ্কের সমারোহ ভিন্ন আর কিছু নয়। মদের তৃষ্ণা জলে মিটিবে কেন ? নিত্য পাত্ৰ ভরিয়া তীব্র সুরা সম্মুখে ধরিবে মানুষের জীবন তেমন সাকিও নয়। রাত্ৰে প্ৰসন্ন আশ্চর্য স্বপ্ন দেখে । একটা খাড়া উচু পাহাড়। তার উপবে প্রসল্লের স্কুল। অনেক বয়সে স্কুলে পড়িতেছে বলিয়া প্ৰসন্নের বড়ো লজ্জা, টিফিনের ছুটিব সময় স্কুলের সামনে পাহাড়ের একেবারে ধারে সে চুপচাপ দাঁড়াইয়া আছে। হঠাৎ একটা ছেলে তাহাকে এমন ধাক্কাই দিল যে পাহাড়ের নীচে আছড়াইয়া না। পড়িয়া প্ৰসন্নের আর উপায নাই ; কারণ আজ শাড়ি পরিয়া স্কুলে আসিয়াছে বলিয়া উড়িবার প্রক্রিয়াটা সে ভুলিয়া গিয়াছে। পাহাড়েব ঠিক নীচে একটা ইদারা, শূন্যে পড়িতে পড়িতে প্ৰসন্ন বিবেচনা করিয়া দেখিল ইচ্ছা করিলে ইদারার মধ্যেও পড়া যায় অথবা একটু বঁকিয়া ইদারার পাকা বঁধানো পাড়েব উপরেও আছড়ানো চলে। কী করা উচিত ? আধাআধি পড়িয়া সে মনস্থির করিয়া ফেলিল। ইদাবাব জলে পড়িলে লাগিবে না বটে, কিন্তু ওর মধ্যে আবছা অন্ধকার, ওর মধ্যে অজানা রহস্য। তাছাড়া নিজেব চেষ্টায় উঠিয়া আসিতে না পরিলে ওর মধ্যেই তাহাকে বাকি জীবনটা কাটাইতে হইবে। হেডমাস্টার নিয়ম করিয়াছেন কোনো ছেলে ইদারায় পড়িলে তাহাকে আর তোলা হইবে না। নীেকার হালের মতো হাতেব খাতায় বাতাস কাটিয়া প্ৰসন্ন ইদাবার পাড়ে আছড়াইযা পড়িল । হাত-পা ৬াঙিল না বটে, কিন্তু আঘাত লাগিল, সত্যিকারেব আছাড় খাওয়াব সমােনই। স্বপ্নে আর বাস্তবে ও ছাড়া আর তফাত আছে কি ? ভালোবাসিয়া যাহাকে পাই নাই, স্বপ্নে সে পাশে আসিয়া বসিলে এই স্বপ্নে পাওয়াব মধ্যে শুধু বাস্তবতার ফাকিটুকুই থাকে বলিযা বাঁচা সম্ভব হইয়াছে। স্বপ্নকে তাহাব ন্যায্য মূল্য দিতেই হইবে। প্রসন্ন উঠিয়া আলো জুলিল। জল খাইযা গায়ে একটা চাদর জড়াইয়া চুপচাপ বিছানায় বসিয়া রহিল। শুধু বাড়ি নয়, সমস্ত পাড়াটা নিঝুম হইয়া পড়িয়াছে। আলোটা ভযে ভয়ে মিটমিটি জুলিতেছে, রাস্তাব আলো এতখানি অস্তবালে যে অস্তিত্বেব মৃদু প্রমাণটাই বিস্মযকর। এ যেন রাত্রি নয়, শঙ্কার কুয়াশা ৷ প্ৰসন্ন ভাবিতে লাগিল, একটা বউ থাকিলে এ সময় কাজ দিত। প্ৰেমালাপ, মানুষের সঙ্গে দুটি সাধারণ কথা বলিবাব এত বড়ো প্রযোজনা কি সচরাচর আসে ? বউ নিশ্চয় তাহার ভয়ের ভাগ লাইত, দু চোখ বড়ো বড়ো কবিয়া ভীতকণ্ঠে বলিত, কী গো কী ? সে বলিত, কিছু না, বড্ড মশা লাগছে। উঠে মশারিটা একবাব ঝাড় না ? আলোটা বাড়িয়ে দাও, আমার বড়ো ভয় করছে। আমি রয়েছি ভয় কী ? বলিযা সে হাসিত। বউ তথাপি বলিত, না না, আলোটা তুমি বাড়িয়ে দাও। মা কেমন করিয়া টের পাইয়াছিলেন, উঠিযা আসিয়া জানালা দিযা প্রশ্ন করিলেন, রাতদুপুরে আলো জেলে বসে রয়েছিস যে ? একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম, মা। তা দেখবি না ? যে অনাচারটাই তুই করিস। কাপড়ে ভাত পড়ল, পইপই করে বারণ করলাম কানে তুললি না, সেই কাপড়ে এসে শূলি। নে, মা দুৰ্গাকে ডেকে আলো নিবিয়ে ঘুমো। পরদিন সকালে মা বলিলেন, এবার একটা বিয়ে কর বাবা, মাথা খাস। রোজগারপাতি করছিস সকালে বউয়ের প্রয়োজন মিটিয়া গিয়াছে, খবরের কাগজটা নামাইয়া প্ৰসন্ন বলিল, কানপুরে কী ভয়ানক কাণ্ড হয়েছে জানো মা ? একটা আপিসের ছাদ ভেঙে সাতজন কেরানি মারা গেছে, পনেরো জন জখম হয়েছে।