পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

文8 মানিক রচনাসমগ্র নদীতীরে নীেকায় তাহাদের কাজ ছিল। খাওয়া দাওয়ার পর নীেকা লইয়া তাহারা সোনাখালির মেলায় যাইবে। সঙ্গে ছেলেমেয়েরা থাকিবে, কেতুপুর ও আশেপাশের গ্রাম হইতে এমন যাত্রীও পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যাহারা ভাড়া দিয়া মেলায় যাইবে। নৌকাটা একটু সাফ করিয়া একটা অস্থায়ী হোগলার ছই খাটাইয়া দেওয়া দরকার। নীেকার ছোটো পালটি মেরামত করিবার জন্য নাবানো হইয়াছিল, বাঁশের মাস্তুলে সেটিও আবার ঠিক করিয়া খাটাইতে হইবে। বর্ষাকালে বাতাস প্রায় সোনাখালির দিকেই বহিতে থাকে, গুমোট করিয়া সামান্য বাতাস যদি উঠে, পাল তুলিয়া মেলাখ পৌছিতে আজ একঘণ্টা সময়ও লাগিবে না। নদীর ধারে পৌঁছিয়া তাহারা দেখিতে পাইল ছাতি মাথায় দিয়া হােসে মিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ঘর ছাইবার জন্য হােসেনের কাছে বিনামূল্যে কিছু শণ পাইবার সম্ভাবনা ছিল, তাহাকে দেখিয়া কুবেরের খুশি হওয়াই উচিত ছিল। তবু লোকটার আবির্ভাবে চিরদিন যে দুজ্ঞেয় আশঙক তাহাকে অস্বস্তি বোধ করায় আজও সেই আশঙ্কাই হঠাৎ তাহাকে দাঁড় করাইয়া দিল। চুপিচুপি বলিল, হোসেন মিয়া রে গণেশ ! তাই তো দেহি ! একটু রহস্যময় লোক এই হােসেন মিয়া। বাড়ি তাহার নোয়াখালি অঞ্চলে। কয়েক বৎসব হইতে কেতুপুরে বাস করিতেছে। বয়স তাহার কত হইয়াছে চেহারা দেখিযা অনুমান করা যায় না, পাকা চুলে সে কলপ দেয়, নুরে মেহেদি রং লাগায়, কানে আন্তর মাখানো তুলা গুজিয়া রাখে। প্রথম যখন সে কেতুপুরে আসিয়াছিল পরনে ছিল একটা ছেড়া লুঙ্গি, মাথায একঝাক বুক্ষ চুল---ঘষা দিলে গায়ে খড়ি উঠিত। জেলেপাড়া নিবাসী মুসলমান মাঝি জহরেব বাড়িতে সে আশ্রয লইযাছিল, জহরের নীেকায় বইঠা বাহিত। আজ সে তাহার বেঁটে খাটাে তৈলচিকুণ শরীরটি আজানুলম্বিত পাতলা পাঞ্জাবিতে ঢাকিয়া রাখে, নিজের পানসিতে পদ্মায় পাড়ি দেয়। জমি-জায়গা কিনিযা, ঘরবাড়ি তুলিয়া, পরম সুখেই সে দিন কটাইতেছে। গতবছর নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে দু নম্বর স্ত্রীকে। এইসব সুখের ব্যবস্থা সে যে কী উপায়ে করিয়াছে গ্রামের লোক ঠিক অনুমান কবিয উঠিতে পাবে না। নিত্য নূতন উপায়ে সে অর্থে পার্জন করে। নীেকা লইয়া হয়তো সে পদ্মায় মাছ ধধিতে গেলগেল সে সত্যই, কারণ যাওয়াটা সকলেই দেখিতে পাইল, কিন্তু পদ্মার কোনখানে সে মাছ ধবিল, মাছ বিক্রিই বা করিল কোন বন্দরে, কারও তােহা চোখে পড়িল না। তাহার নীেকার মাঝিদের জিজ্ঞাসা করিয়া একটা গল্প মাত্ৰ শোনা গেল যে, যে বন্দরে তাহারা মাছ বিক্ৰয় করিযাছে সেখানে নৌকাব্য যাতায়াত করিতে নাকি সাত-আটদিন সময় লাগে। তারপর কয়েকদিন হয়তো হোসেন গ্রামেই বসিয়া থাকে, একেবারে কিছুই করে না। হঠাৎ একদিন সে উধাও হইয়া যায়। পনেরো দিন একমাস আর তাহার দেখা মেলে না। আবির্ভাব তাহার ঘটে। হঠাৎ এবং কিছুদিন পবে দুশো গোরু, ছাগল চালান হইয়া যায় কলিকাতায় । বড়ো অমায়িক ব্যবহার হোসেনের। লালচে রংয়ের দাড়ির ফাকে সবসময়েই সে মিষ্টি করিয়া হাসে। যে শত্ৰু, যে তাহার ক্ষতি করে, শাস্তি সে তাহাকে নির্মম ভাবেই দেয়। কিন্তু তাহাকে কেহ কোনোদিন রাগ করিতে দেখিয়াছে বলিয়া স্মরণ করিতে পারে না। ধনী-দরিদ্র, ভদ্র-অভিদ্রের পার্থক্য তার কাছে নাই, সকলের সঙ্গে তার সমান মৃদু ও মিঠা কথা। মাঝে মাঝে এখনও সে জেলেপাড়ায় যাতায়াত করে, ভাঙা কুটিরের দাওয়ায় ছেড়া চাটগাঁইয়ে বসিয়া দা-কটা কড়া তামাক টানে। সকলে চারিদিকে ঘিরিয়া বসিলে তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এইসব অর্ধ উলঙ্গ নোংরা। মানুষগুলির জন্য বুকে যেন তাহার ভালোবাসা আছে। উপরে উঠিয়া গিয়াও ইহাদের আকর্ষণে নিজেকে সে যেন টানিয়া নীচে নামাইয়া আনে। না, মনে মনে ইহা বিশ্বাস করে না জেলেপাড়ার কেহই ; জীবন যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের একেবারে মিলন-সীমান্তে তাহারা বাস করে, মিত্র তাহাদের কেহ।