পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/২৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२१ रै মানিক রচনাসমগ্র হইল, সে যেন তরঙ্গের কথা শুনিতেছে। তরঙ্গই যেন পুরুষ সাজিয়া গলা মোটা করিয়া মঞ্চে দাঁড়াইয়া চিৎকার করিয়া বলিতেছে, আর সমস্ত কান্না ন্যাকামি, দেশের জন্য, দশের জন্য যে কান্না সেই কান্নাই আসল কান্না। একেবারে বক্তৃতামঞ্চে গিয়া চড়াও হওয়ার খেয়ালটা শঙ্করের চাপিল দু নম্বর বক্তাকে দেখিয়া। ভদ্রলোক শঙ্করের চেনা। তবে তিনি যে একা তারই চেনা নন, আরও অনেকেই যে তঁাকে চেনে, সেটা বোঝা গেল। তিনি উঠিয়া দাঁড়ানো মাত্র সভায় মৃদু একটা জয়ধ্বনি উঠায়। ব্যাপারটা বড়ো আশ্চর্য মনে হইল শঙ্করের। বছরখানেক আগেও যিনি ফাঁকি দিয়া--সাধারণ জুয়াচুবির চেয়েও খারাপ। আইনসঙ্গীত জুয়াচুরি করিয়া-বীরেশ্বরের হাজার তিনেক টাকা মারিয়া দিয়াছিলেন, তাকে দেখিয়া জনতার উল্লাস ? কাগজে সম্প্রতি একজন লীলাময় ঘোষেবা নাম দেখা যাইতেছিল বটে মাঝে মাঝে, তিনিই কি ইনি ? পাশবালিশের মতো গোলগােল লীলামায়ের এ তো এক অপরূপ লীলা ! মঞ্চে উঠিলার অধিকার শঙ্করের ছিল না, কিন্তু রাজসিংহাসনে উঠিবার অধিকারও শুধু অপেক্ষা রাখে অৰ্জ্জুনের। বাধা মানিবার মতো মন তাব ছিল না, বাধা সে ঠেলিয়া সরাইয়া দিল দুহাতে, গভীর মুখে একটু মাথা হেলাইযা সমস্ত প্ৰতিবাদে সাব্য দিয়া বসিযা পড়িল লীলাময় ঘোষেরই খালি চেয়ারটিতে। উদাস মধুব সজল কান্নার সুৰে লীলাময় তখন বক্তৃতা আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন। সুর। যেমনই হােক থাকিয়া থাকিয়া এমন সব বিশ্ৰী হাসির কথা তিনি বলিতে লাগিলেন যে, সভায চাপা হাসির গুঞ্জন উঠিতে লাগিল। বক্তৃতার এ একটা টেকনিক,--“কঁদে|”-“কঁদো’ গোপাল ভাড় মানুষকে মুগ্ধ করে বেশি। একবার হাসিটা হইল প্রবল, মিনিটখানেক গোলমাল থামিল না। সেই অবসরে লীলাময় জিজ্ঞাসা করিলেন, কী খবব শঙ্কবা ? আমি কিছু বলব। বলবে ? আমাকে না সভায় ? ञ्श्रूः । কী সর্বনাশ ! ও সব দুবুদ্ধি কোরো না। লীলাময়েব বক্তৃতা শেষ হওয়ার মাত্র শঙ্কর বিনা ভূমিকায় উঠিয়া দাঁড়াইযা প্ৰাণপণে চিৎকার করিষা বলিতে আরম্ভ করিল, বন্ধুগণ, অনাহূতভাবে আমি আপনাদের একটা সুপরামর্শ দিচ্ছি, আপনাবা ন্যাকামি ছাডুন। আপনারা সকলেই ন্যাকা। কেন জানেন ? আপনারা সকলে একেবা জন্য, দুসেব জন্য, তিনের জন্য কঁদেন, দশের জন্য কাঁদেন না। আপনারা অমানুষ, পশু, অসভ্য, বর্বব। আপনাদের লজ্জা করছে না। এখানে বসে থাকতে ? ঘরের কোণেব একজন দুজন তিনজনের জন্য নিজেকে আপনারা উৎসর্গ কবে দিয়েছেন জানোয়ারের মতো, এই সভায় এসে ভিড় করবার কী অধিকার আপনাদের আছে ? আমি যদি বলি আপনাদের মাঝখানে এখন একটা বোমা ছড়ে মারব, আপনারা যে যার প্রাণ নিয়ে পালাবার জন্য পাগল হয়ে উঠবেন, বড়ো জোর সঙ্গে নেবার চেষ্টা করবে। একজন দুজন কি তিনজনকে, অথচ এমন জমাট বেঁধে আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন, এমন গলাগলি মাখামাখি ভােব আপনাদের,-থামানাের চেষ্টা, টানিয়া বসানাের চেষ্টা, স্বয়ং সভাপতির উঠিয়া দাঁড়াইয়া শ্রোতাদের ব্যাপারটা বুঝানোর চেষ্টা সব ব্যর্থ হইয়া গেল। চার-পাঁচজন স্বেচ্ছাসেবক আসিয়া যখন একসঙ্গে শঙ্করকে চাপিয়া ধরিল, সে গলা ফাটাইয়া শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করিল,--- এরা আমায় বসিয়ে দিচ্ছেন, আপনারা আমার কথা শুনবেন না ? গালাগালি-মুগ্ধ শ্রোতারা বলিল : শুনব ! শূনব ! বেশ তো বলছিল বাপু, বলুক না।