পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৩২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

টিকটিকি দোতলা বাড়ি। শহরের যে অঞ্চল বেজায় শহরে বলে খ্যাত সেইখানে। তিনদিকে গাদকরা বাড়ির চাপ, একদিকে রাজপথের চটুল ফাজলামি, আবেষ্টনীকে লক্ষ করলে সন্দেহ হয়, সমস্তটাই বুঝি হাই মায়ােপিয়ার লীলা। তাছাড়া, এমন চেহারা বাড়িটার যে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা অসবর্ণ রহস্যের মতো কুৎসিত। সস্তা মেযেমানুষ যেন পথিকের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, আমি ভীবু ও সরলা খাঁটি গাঁয়ের মেয়ে, তবে অসতী। বেআবার সমতল পিঠে পুরানো বাদামি রঙের আবরণটা চোখেই পড়তে চায় না, প্রাচীনতার ছাপ। এত বেশি। দোতলা বাডি বটে, একতলা-দোতলায় কিন্তু সিঁড়িব যোগাযোগ নেই। তিনটি সদর দরজার ডাইনেরটি দিয়ে ঢুকলেই খাঁচাবন্দী দোতলার সিঁড়ি। অকারণ নড়াচড়ার একটু স্থান অবশ্য আছে, কিন্তু সিঁড়ি বেযে দোতলায় ওঠা অথবা পথে ফিরে-যাওযা ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই কোনো দিকেই। দোতলায থাকেন। ইতিহাসের প্রফেসার, সদর দরজাটির পাশে ছোটো পিতলের ফলকে যিনি এম এ | একতলায় থাকেন জ্যোতিষার্ণব, বাকি দুটি সদর দরজার উপরে কাঠের ফ্রেমালাগানো রঙিন টিনের মস্ত সান্টনবোর্ডে যিনি প্রথিতযশা। দুটি দরজাই একটি ঘরের, যার বেশিব ভাগ জ্যোতিষার্ণবের গণমালয়, বাকিটুকু অন্দরের প্যাসেজ। তিনটি সদর দরজার মাঝেরটি দিয়ে ঢুকলেই ডাইনে দোতলার সিঁডি-আড়াল-কবা দেয়াল আর বঁাযে দুটি বই-ভরা আলমারির বেআববু, পিঠ। এগিয়ে এগিয়ে যখন অন্দরের দািবজা ডিঙিযে জ্যোতিমাৰ্ণবের আবছা অন্ধকাৰ স্যাতসেঁতে অন্দরে পদাৰ্পণ না করে প্রায় আর উপায় থাকে না, তখন দেখা যায়, আলমারিব দেয়াল একেবারে অন্দরের দেয়ালে গিযে ঠেকেনি, ফাক আছে হাতখানেক। এই ফাকটুকু দিয়ে জ্যোতিষার্ণব নিজে আর তার নিজের লোক অন্দর থেকে গণনালয়ে যাতায়াত করে । বাইরের লোক আসে তিন নম্বর সদর দরজা দিয়ে। এসে ডবল চৌকির ময়লা ফরাশেই হোক আর অয়েলক্লথ-মোড়া টেবিলেব সামনে কাঠেব চেয়াৰেই হোক, বসে। বসে চারিদিকে তাকায়, বিশ্বাস-অবিশ্বাস শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধা আশা-নিবাশাব্য ভারে বিব্রত চোরের মতো। যা চোখে পড়ে। তাই মনকে নাড়া দেয়, দেযালেব টিকটিকি পর্যন্ত। সস্তা মেয়েমানুষ যেন সমস্ত পরপুরুষের দৃষ্টি নিযে নিজের সমালোচনা কবিছে, আমার কী উপায হবে ? আসলে, এ ছাড়া প্রশ্নও নেই জগতে। সব কিছুতে এই সমস্যাব ছাপ মারা। ভবিষ্যৎ কি সব কিছুকে গ্রাস করে নেই ? জ্যোতিষার্ণবের কপালে চন্দনেব ফোটা দেবার সময় তার ছেলেমেয়ের মা মাথা কাত করে, চােখ উলটে দেয়, মোটা আলগা ঠোঁট দুটিকে টান করে হাসে। জ্যোতিষার্ণবের অপরাধ, সাতবছর আগে এই ভঙ্গি তাকে ভুলিয়েছিল। তবে, কেবল ভঙ্গি নয়। সেই সঙ্গে জিজ্ঞাসাও করে, আমি মরলে তোমার কী উপায় হবে ? জিজ্ঞাসা করে সকালবেলা আর মবে যায়। সেই সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে, তবু মনে হয় প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করেই যেন সে মরে গেল। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ যার নখদর্পণে, সেও বুঝতে পারে না ব্যাপারখানা কী। তার ছেলেমেয়ের মা মবণের কথা বলবে মনে করার আগেই মাথার উপর কড়িকাঠে যে টিকটিকিটার মানিক ২য়-২১