পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৩৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মিহি ও মোটা কাহিনি \©ó ዓ ইন-মেমোরিয়মের মতো যার অমরতা চারণীকে অমর করবে। তাকেও করবে। অবশ্য কিন্তু সেটা বাহুল্য, তার কোনো প্ৰতিকার নেই। পুরানো দিনের মতো কাগজপত্র ছড়িয়ে, বিদ্যুতের আলো নিভিয়ে বুপোর দীপাধাবে মোমবাতি জ্বালিয়ে সে লিখতে বসল। পাশের ফুলদানি থেকে সোনা রঙের চাপা আর সবুজ রঙের কঁঠালিচাপা ফুল পুরানো দিনের মতো তাকে তীব্র মিশ্রিত গন্ধ সরবরাহ করতে লাগল। গভীর রাত্রির নিজস্ব ছাড়া ছাড়া শব্দ দিয়ে ভাগ করা যে স্তব্ধতায় আগে সে কবিতা লিখত। আজও সে স্তব্ধতাই তাকে ঘিরে রইল। কিন্তু এক লাইন কবিতা সে লিখতে পারল না, কলম হাতে করে যতক্ষণ সে ঈষৎ নীলাভ কাগজের দিকে চেয়ে রইল। তার সময় বোপে তার মনে জেগে রইল। এই কথাটা যে, চারণীকে আমরতা দেবার জন্য সে কবিতা লিখতে বসেছে। এই জ্ঞানকে মগ্নচেতনায় তলিয়ে দিয়ে আসল কবিতাকে সে মনে আনতে পারল না। মহাব্ৰতর ভয় হল। পরদিন সে আবার লিখবাব চেষ্টা করল। যে অবস্থায় সে তার শ্রেষ্ঠ কবিতা রচনা করেছে তেমনই অনুকূল অবস্থাতেও আজ এক লাইন কবিতা তার মনে এল না। কতকগুলি জোড়-বিজোড় শব্দ শুধু তার মনে ভেসে বেড়াতে লাগল। মহাব্রতর শান্তি নষ্ট হযে গেল। ভয়ে সে যেন মরার মতো হয়ে গেল। এ কোন অদৃশ্য দুর্বোধ্য শক্তি তার প্রকাশের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে, তাব কাব্যের উৎসমুখে শিলাব মতো চেপে বসেছে ? আব আত্মাকে অবরোধ করেছে কীসে ? মহাব্ৰতর ঘুম এল না বলে তার মদ খাবার ইচ্ছা হল। বাড়ি থেকে মদের গন্ধাটুকুও বিতাড়িত করে দিয়েছিল বলে হঠাৎ সবদিক দিয়ে নিজেকে ব্যর্থ ও অসহায় মনে করে সে কঁাদল। সেদিন সকালে অরবিন্দের সন্টুডিওতে চারণীকে দেখে সে টের পেয়েছিল চারিণী অরবিন্দকে ভালোবাসত। তা না হলে অরবিন্দেব জন্য সে আমন করে হাসবে কেন, আমন করে চাইবে কেন ? সে দিন থেকে মহাব্রিতের একটা স্বৰ্গ ভেঙে ধুলায় লুটিয়ে পড়েছে। চারণীর অমর স্মৃতিকাব্যটিও যদি সে লিখতে না পারে, সেই পরাজয় সে সহ্য করবে। কী করে ? বেঁচে থাকবে সে কীসের জন্য ? বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য অবশ্য জগতে সংখ্যাতীত, খুঁজলেও মেলে, না খুঁজলেও মেলে, কিন্তু মহাব্ৰত প্রতিভাবান কবি বলে চারণীর স্মৃতিকে অবলম্বন করে এক অমর ব্যথাকাব্য রচনা করা ছাড়া জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্যই দেখতে পেল না। এও সে ভুলে গেল যে উত্তেজিত অশাস্ত মন নিয়ে অমর কাব্য রচনা করা যায় না। হ্যালামের মৃত্যুর সতেরো বছর পরে টেনিসনের ইন-মেমোরিয়ম প্রকাশিত হয়, বন্ধুকে যখন কবি ভুলে গেছে, সুদূর অতীতে নিয়তির বৃঢ় আঘাতে প্রাপ্ত ভাব-তরঙ্গের স্মৃতিটুকু মাত্র যখন কবির অবলম্বন, বন্ধুবিয়োগ-বেদনা নয়। আর সে তো শুধু বন্ধু। নিজের মরণ ঘনিয়ে না এলে সুদূর অতীতে হ্রদয়ে বিপর্যয় আনা স্মৃতিটুকু মাত্র মনে রেখে মৃতা প্রিয়াকে কে ভুলতে পারে যে আমব স্মৃতিকাব্য লিখতে পারবে ? করুণ রসে টইটম্বর কবিতা লেখা যায়, উদভ্ৰান্ত প্রোেমর সেই আবেগ উগ্ৰ কাব্য নিয়ে মানুষ হইচইও করে, কিন্তু লোনা রাসায়নিক চোখের জলের মতো সে বাঁচবে কেন, সে উপে যায়,-সে তো মড়াকান্না। প্রতিভাবান কবি হয়েও মহাব্ৰত এ সব কথা যেন ভুলে গেল। জবরদস্তি করে পরপর কয়েক রাত্রি সে কাব্য লিখল আর সকালে উঠে না পড়েই ছিড়ে ফেললে। তারপর সে শহর ছেড়ে গেল পালিযে। নানা দেশ ঘুরে মন একটু ঠান্ডা হয়ে এলে হঠাৎ একদিন তার মনে হল চারণীকে নিয়ে যে কারণে সে কবিতা লিখতে পারেনি তা হয়তো এই যে, তার কবি-মন কাব্যরচনার অনুপযোগী স্মৃতিকেই শুধু গ্ৰহণ করেছে। চারণীর জীবনে যে আবহাওয়া ছিল, যেটুকু বাস্তবতা সমস্ত কবিকল্পনার ভিত্তি, হয়তো সে তা হারিয়ে ফেলেছে। যে সব বস্তু ও বাস্তবতা চারণীকে ঘিরে ছিল তাদের মাঝখানে বসে লিখলে সে লিখতে পারবে। চারণীর অনুশীলন কক্ষটির কথা মহাব্রতর মনে এল। সে ঘরে দীর্ঘ