পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৩৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Y€ዕ¢ኳ” মানিক রচনাসমগ্ৰ কাল ধরে সে নিজেকে প্ৰতিভার উপযোগী করে গড়ে তুলেছিল। সেই ঘরে বসে সে ছবি আঁকত, কবিতা পড়ত, ভাস্কর্যের চর্চা করত, সাহিত্যের পরিচয় নিত। চারণীর আঁকা ছবি ও খোদাই করা মূর্তি, তার পড়া অসংখ্য বই, তার ব্যবহার-করা অসংখ্য বস্তু সে ঘরে চারণীর স্বকীয়তাকে আজও ধরে রেখেছে। ওই ঘরে দুদণ্ড বসলে স্মৃতিকাব্যের আরম্ভটা হয়তো সে আয়ত্ত করতে পারবে। ভয় করে। প্ৰথমে দুদিন বিশ্রাম করে নিল। পরের দিন সকালে সে গেল চারণীদের বাড়ি। শুনল চারণীর সেই ঘরখানা সাফ করে তিনদিন আগে প্রিয়ংবদা একটি মেয়ে প্রসব করেছে। চারণীর ছবি বই প্রভৃতি জিনিসপত্র খানিক এ-ঘরে ও খানিক সে-ঘরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চারণীর শোবার ঘর ? সে ঘরে চারণীর পিসিমা শোন। তারপর মহাব্ৰত অনেক ভেবে একদিন অরবিন্দের সন্টুডিওতে গেল। সেখানে চারণীকে একবার অনেকক্ষণ ধরে দেখে এসে শেষ চেষ্টা করে দেখবে। এতে তার লজ্জা, চারণীকে অমর করার গৌরব এতে তার ক্ষুন্ন হবে। কিন্তু উপায় কী ? যেখান থেকে হােক স্মৃতিকাব্য আরম্ভ করার প্রেরণাটুকু সংগ্ৰহ করতে না পারলে তার যে একেবারেই পরাজয়। অরবিন্দ তাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে বলল, আসুন। মহাব্ৰত চেয়ে দেখল, চারণীর দ্বিতীয় প্রতিমূর্তি সমাপ্ত হয়েছে। আগেকার হাস্যমুখী মূর্তির চেযে এ মূর্তি বহুদিক দিয়ে ভিন্ন—সব দিক দিয়ে। সে মূর্তির খুঁত ও অসম্পূর্ণতা আজ এ মূর্তির সঙ্গে তুলনা করে সে ধরতে পারল। চোখের পলকে এও সে বুঝতে পারল এবারও অরবিন্দের কাছে তার হার হয়েছে। অরবিন্দ সৃষ্টি করেছে চারণীকে, ঈষৎ স্থূলকায়া, ভীৰু চােখ, শ্ৰান্ত বিপন্ন হাসি, দ্বিধা-সন্দেহ-ভয়ে লেপা মুখ, নিখুঁত ও আসল চারিণী। অরবিন্দ তাকে অমরতা দেয়নি, পরের কাছে এ মূর্তি হয়তো প্ৰশংসার বেশি কিছু পাবে না, কিন্তু কী দাম অমরতার ? অরবিন্দ যতকাল বাঁচবে চারণী তার সঙ্গে থাকবে। মৃত্যুর কবল থেকে ছিনিয়ে এনে চারণীকে সে জীবন-সঙ্গিনী করেছে। এরপর তাকে স্মৃতিকাব্যের অমরত দিতে চাওয়া হাস্যকর। মহাব্ৰতর মাথার ভেতরে কেমন গোলমাল হয়ে গেল। অরবিন্দের হাতুড়ি আর বাটালিটা তুলে নিয়ে চারণীর মুখখানা সে ক্ষতবিক্ষত করে দিল। সে যেন অসতী স্ত্রীকে সাজা দিচ্ছে। অরবিন্দ সবটুকু জীবনীশক্তি ব্যয় করে এই মূর্তি গড়েছিল। চামড়া দিয়ে হাড়-ঢাকা শরীরে তার একটুও শক্তি ছিল না। এবারও সে তার চারণীকে বাঁচাতে পারলে না।