পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৩৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মিহি ও মোটা কাহিনি vo ছোড়া যে ইতিমধ্যে সাড়ে তিনশো টাকার চাকরি বাগাইয়া আটঘাট বাঁধিয়া আসিয়াছে, আমি কি সে সংবাদ রাখি ? প্রথমটা বেশ ভাড়কাইয়া গেলাম, কিন্তু মুহূর্তে সামলাইয়া নিয়া বলিলাম, তা হােক, তোমার সঙ্গে আমি ওর বিয়ে দেব না। কেন দাদু ? সে কৈফিয়ত তোমাকে দেব কেন হে বাপু ? বাধা আছে। এইটুকু শূনে রাখ, বলিয়া আমি ফের রাগিয়া আগুন হইয়া উঠিলাম ! দিন চারেকের মধ্যে সমস্ত ব্যবস্থা করিয়া শিলাকে বলিলাম, তল্পিী বঁধ শিলা, এখানকার বাস তুলতে হল। শিলা সজলচোখে বলিল, কেন দাদু ? বেশ তো আছি। এখানে ? বেশ থাক আর যাই থাক, পরের দিন জিনিসপত্র সব গাড়ির ছাদে চপাইয়া শিলাকে ভিতরে বসাইলাম। কিছু ফেলিয়া গেলাম কী না দেখিতে পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়ির ভিতরে গিয়াছি, ইহার মধ্যে ভূপেন আসিয়া গাড়ির সামনে দাঁড়াইয়াছে। শূক্ষ হাসিয়া বলিলাম, ভূপেন যে ! আমরা তো চললাম। একটা কথা শুনুন দাদু, বলিয়া সে আমাকে একান্তে নিয়া গেল। কোথায় যাচ্ছেন ? শিলাও জানে না বললে। হাসিয়া বলিলাম, কোথায় যে যাচ্ছি। আমিও জানি না হে ! কোনো গুহা-টুহায় আশ্রয় নেব ভাবছি। এক মুহূর্ত স্তব্ধ থাকিয়া ভূপেন বলিল, আপনার মত কি কোনোদিন বদলাবে না। দাদু ? এ বিয়ে না হলে আপনার নাতনি অসুখী হবে। গভীর হইয়া বলিলাম, দ্যাখো বাপু কবি, তোমায় একটা সৎ উপদেশ দিই। শুধু কাব্যচর্চা করে জীবনটা মাটি কোরো না। জীবনে আরও ঢ়ের বড়ো বড়ো সাধনার সুযোগ আছে। বলিয়া গাড়িতে উঠিয়া পড়িলাম। আমার সামনেই শিলা যতক্ষণ দেখা গেল ভূপেনের দিকে একদৃষ্টি চাহিয়া রহিল। হে পাঠক হে পাঠিকা, কৈফিয়ত আমি দিব না। শুধু কয়েকটা কথা বলি। শিলাকে নিয়া আমি যে আদিকাব্য রচনা করিতে চাই, ত্যাগের কাব্য তার চেয়ে বড়ো, এ কথা মানা আমার পক্ষে আত্মপ্রবঞ্চনা। ভূপেনের হাতে শিলাকে সঁপিয়া দিয়া আমি শূন্য ঘবে বুক চাপড়াইলে আপনারা খুবই খুশি হন, কিন্তু তাহাতে আমার কী লাভ ? কেনই বা শিলাকে আমি ছাড়িব ! বিলাইয়া দিবার জন্য এত কষ্টে এত যত্নে আমি ওকে মানুষ করি নাই। গুহায় ফেলিয়া আসিলে ও বঁচিত না। আমি ওর প্রাণ রক্ষা করিয়াছি। আমার চেয়ে ভূপেনের অধিকার বেশি কেমন করিয়া ? আপনারা ন্যায়বিচার করিবেন। আপনারা বিশ্বাস না করিতে পাবেন, শিলাকে আমি ভালোবাসি। আমার যেমন প্রকৃতি, আমার ভালোবাসাও তেমনই। দেড়শো কোটি মানুষের মধ্যে আমি যেমন মিথ্যা নাই, আমার এই ভালোবাসাও তেমনই মিথ্যা নয়। আমার এ প্ৰেম যেন গোড়া ঘেষিয়া কাটা তরুর মতে-শাখা নাই, কিশলয় নাই, পাতা নাই, ফুল নাই, শুধু আছে মাটির উপরে শক্ত গুড়ি আর মাটির নীচে সরস সতেজ মূল, যাহার রস সঞ্চয় কেবল নিজেকে পুষ্ট করিবার জন্যই। বাস্তবিক, ভাবিয়া দেখিলে বােঝা যায় আমি যে আমার বিশাল