পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৪২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সরীসৃপ 8 Sq\S) সুলতা মৃদুস্বরে বলিল, তা ছাড়া কী ? কঁচাপাকা দাড়ির মধ্যে অঙ্গুলি চালনা আরম্ভ করিয়া যাদব চিন্তিতভাবে মাথা নাড়িতে লাগিলেন। সুলতার কথায় যথেষ্ট আশ্বস্ত হইলেও জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তাহাকে যেন বিচলিত করিয়া তুলিয়াছে। বিশ্বাস করেন না। কিন্তু এ রহস্য যেন তিনি চিনেন। সরমা পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। সুলতার সঙ্গে যাদবকে কথা কহিতে দেখিয়া তারা যেন চেতনা হইল। বউকে কাছে ডাকিয়া বলিলেন, চিত্রা এ সব কী বলছে ছোটোবউ ? তুমি কিছু জান ? এ বাড়ির সকলকেই সুচিত্র পরিহার করিয়া চলে। কিন্তু কী কারণে বলা কঠিন। সুলতাব সঙ্গে তার ভাব আছে। এ বাড়িতে সুলতার দুপুরগুলিই বিনিদ্র। সাতমাসের ভুণের ভারে তাহার পদক্ষেপ মন্থর, কিন্তু সারাটি দুপুর সে এ-ঘর ও-ঘর করিয়া বেড়ায়। চঞ্চল সে নয়, কিন্তু চুপচাপ বসিয়া থাকিতে তরুণী বধুটির যেন দারুণ অস্বস্তি। সুচিত্রার গোপন পরিণয়ের সংবাদ যদি কাহারও জানা থাকে, তবে সুলতার থাকাই সম্ভব। কিন্তু সুলতা কিছুই জানে না। শাশুড়ির প্রশ্নের জবাবে সে মৃদুস্বরে বলিল, জানিনে মা। ও বাড়ির পঞ্চ ছাড়া ঠাকুরঝি তো কারও সঙ্গে কথা কয় না। শুনিয়া সরমা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিলেন। পঞ্চু ছেলেমানুষ, স্কুলে পড়ে। সারমার ছোটাে ছেলেটি বঁচিয়া থাকিলে অত বড়োই হইত এতদিনে। সুচিত্রার বিকৃত মনে এই ভাইটির জন্য কেমন করিয়া একটা আশ্চর্য প্রখর মমতা জন্মিয়াছিল, খুব সম্ভব সেই ভালোবাসাই এখন পাশের বাড়িব গভীর প্রকৃতি ছেলেটির উপর পড়িয়াছে ; পাগল মেযেব অন্ধ উগ্ৰ ভালোবাসা। প্রকাশটি বিচিত্র। পাঁচুব স্কুল বন্ধ থাকার দিনটির প্রতীক্ষায় সুচিত্ৰা ছটফট করে, অন্যদিন তার কাছে পাঁচুব বেশিক্ষণ থাকা নিষেধ, তাড়াতাড়ি লেখাপড়া শিখিয়া পাঁচু মানুষ হােক সুচিত্রার এই আগ্রহ একেবারে নিষ্ঠুব। ছুটির দিন দুপুরটা পাঁচু তার কাছে থাকে। সকালে পঞ্চর পড়া চাই, বেশ মনোযোগ দিয়া পড়া চাই, সুচিত্রাব মাথার দিব্যি। খাওয়াদাওয়াব পাব এগাবোটা কি বারোটার সময় সলজভাবে পঞ্চ আসিয়া দাঁড়ানোমাত্র তাহাকে ভিতবে নিয়া গিযা সুচিত্রা ঘরে দুযার দেয়। পাঁচটা অবধি ছেলেটিকে লইয়া হাসিযা কঁাদিয়া সোহাগ করিয়াও তার যেন তৃপ্তি হয় না। ভাঙা ভাঙা কথা তাহার এমনই দুর্বোধ্য, পঞ্চকে সোহাগ করিবাব সময় তাহা এত বেশি জডাইয়া যায় যে বাহির হইতে শুনিলে মানে বুঝা যায় না। কিন্তু সূরটা এমন করুণ যে চোখে জল আনিয়া দেয়। যাদবের বড়ো ছেলে সতীশ স্নানমুখে সরমার মুখের দিকে চাহিয়াছিল, সরমাকে চোখ মুছিতে দেখিয়া সে আর আত্মসংববণ করিতে পারিল না ! মিছামিছি কেন কঁদছেন মাসিম ? ওর কথার কী কোনো দাম আছে ? সতীশের চোখ ছলছল করিতে লাগিল। সরমার চোখেমুখে ব্যথা আরও ঘনীভূত হইয়া আসিল। সতীশের সহানুভূতি তার সহ্য হয় না। বুকের মধ্যে কেমন করে। সতীশ আবার বলিল, আপনার হার্ট দুর্বল, এ রকম অধীর হবেন না মাসিমা । সরমা শ্বাস টানিয়া বলিলেন, আমার বুক ধড়ফড় করছে সতীশ। সতীশ চমকাইয়া উঠিল, বুক ধড়ফড় করছে ! এরা দেখছি আপনাকে বাঁচতেই দেবে না। মাসিমা। চলুন, আপনি একটু শুয়ে থাকবেন। এইখানে একটু বসি, সতীশ।