পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৪৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8や28 মানিক রচনাসমগ্ৰ তাহার মা হেমলতা বলেন, হ্যারে, ওরা কি যাবে না ? কোথায় যাবে ? যে চুলোয় খুশি, আমাদের তা ভাববার দরকার ? কদিন দ্যাখ, তারপর নিজের পথ দেখে নিতে বলে দে। তাড়িয়ে দিতে পারব না, মা ; ও সব আমার ধাতে নেই। নিজে থেকে যায় তো যাবে, নইলে রইল। কয়েকদিন পরে বনমালী আবার চাবুকে বলে, শুনলাম, তুমি নাকি তীর্থে যেতে চাও ? আমায় বলনি কেন চাবুদি ? আমি সব ব্যবস্থা করে দিতাম। তোমার ধর্মকর্মে আমি বাধা দেব কেন ? বুদ্ধির ধারা পড়িয়া গেলেও চাবু এত বোকা হইয়া পড়ে নাই যে ভুবনকে লইয়া এ বাড়ি হইতে নড়িবে। বনমালীর দুর্বলতা সে জানে। বনমালী সোজাসুজি কাহারও প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখাইতে পারে না। সামনে যে উপস্থিত থাকে তাহার মনে বেদনা দেওয়া বনমালীর সাধ্যাতীত। তার মনের চলাফেরার প্রস্তরময় পথে সে এক পর্যত মাটি বিছাইয়া ফুল ফুটাইয়া রাখিবারই চেষ্টা করে। তীর্থদর্শন কামনা রাখার অপবাদ চাবু তাই অস্বীকার করে। বলে, কই তীর্থে যাওয়ার কথা আমি তো কিছু বলিনি ? ও, হ্যা, মনে পড়েছে। মামিকে বলছিলাম, স্বামী শ্বশুরের এই তীর্থ ছেড়ে আমার এক পাও কোথাও নড়তে ইচ্ছে করে না। মাসিম বুঝি মনে কবেছেন, আমি তীর্থে যেতে চাই ? বনমালী একটা হাই তোলে। মেয়েমানুষের এত বুদ্ধি তার ভালো লাগে না। তবু, দেশ বেড়ালে ভুবনের একটু উপকার হত। হায়রে কপাল, ওব আবাব দেশ বেড়ানো ! চাবু কঁদোকাটা করার উপক্ৰম করে। বনমালী আর কিছু না বলিয়া বাগানে পায়চারি কবিতে যায়। ভাবে, কী আর হইবে, থাক । গ্রামকে গ্রাম ঘাড়ে আসিয়া চাপিয়া বসিয়া আছে, চাবুদিব ভারটা আব্ব এমন কী গুৰু ! কঁকর-বিছানো পথের ঠিক মাঝখান হইতে দুটি কচি সবুজ ঘাসের শীষ বাহির হইয়াছে দেখিয়া বনমালী থমকিয়া দাঁড়ায়। পকেট হইতে একটি টাকা বাহির করিয়া যমজ ভাইয়ের মতো তাদেবী দুটিকে সে চাপা দিয়া দেয়। ভাবে, আগে চাবুর যদি টাকা না থাকিত ! তারপর একদিন পরী বিধবা হইয়া দিদির কাছে চলিয়া আসিল । ছেলেকে সাবধানে মাটিতে নামাইযা রাখিয়া গড়াগড়ি দিয়া কঁদিয়া কঁাদিয়া সে বলিতে লাগিল, দিদি গো, আমার কপাল পুড়েছে গো। কে অভিশাপ দিয়ে আমার এমন করলে গো, কে করলে ! গলায় আঁচল জড়াইয়া পাক দিয়া পরী গলায় ফাস দিবার চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু হেমলতা ফাস খুলিয়া দেওয়ায় সে চেষ্টা সে ত্যাগ করিল। খানিকক্ষণ মেঝেতে কপাল কুটিয়া হাত কামড়াইয়া চেচাইয়া এক বিষম কাণ্ড বাধাইয়া তুলিল ও ছুটিয়া নিজের ঘরে গিয়া দাড়াম করিয়া দরজা বন্ধ করিযা দিল। গলায় সে যে আর ফাস দিতেছে না সেটা বেশ বুঝা গেল, কারণ বাহির হইতে ভগবানের কাছে তাহার একটানা আবেদন শোনা যাইতে লাগিল, আমায় নাও ভগবান, এবার আমায় নাও। বনমালী পরীকে সাস্তুনা দিয়া বলিল, আমন করে কঁদিসনে পরী ; ছেলের মুখ চেয়ে বুক বাঁধ। নে ওঠ, উঠে মাই দে ছেলেকে, ককিয়ে ককিয়ে গলা যে ওর কাঠ হয়ে গেল রে। হেমলতা বনমালীর সান্তুনা প্ৰত্যাহার করিয়া নিলেন। ওকে এখন ও সব বলিস নে বনমালী, কঁদতে দে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওর শুনেছি যে দজাল, প্ৰাণ খুলে সেখানে কী ও একটু কঁদিতেও পেরেছে রে । এই প্রাণঘাতী শোক জোর করে চেপে রেখে শেষে কী অসুখে পড়বে মেয়েটা ? খানিক কেঁদে নিক।