পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৪৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সরীসৃপ 8ぐう。 মনে মনে মস্ত এক প্রতিজ্ঞা করিয়া আঠারো বছরের ঘুমস্ত ছেলের মাথায় সিস্নেহে চুমা খাইয়া চাবু মেঝেতে তাহার সংক্ষিপ্ত কম্বলের শয্যায় নামিয়া গেল। . এ বাড়িতে পাপের বন্যা বহিয়া যাক, এ ঘরখানাকে সে পবিত্ৰ মনে করিবো।-যতদিন বাঁচে সপুত্র এই ঘরের বায়ু সে নিশ্বাসে গ্রহণ করিবে। বাহিরে এমন বৃষ্টি হইয়া গেল, তাহাদের গায়ে লাগিল কি ? বাহিরে যত অন্যায়ই ঘটিয়া চলুক তাহাদের গায়ে ছোঁয়াচ লাগিবে না। এই কথাটা বারবার ভাবিয়া এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করিয়াও চাবু কিন্তু সমস্ত রাত ঘুমাইতে পারিল না। পরীর আদিম শৈশবের ইতিহাস ছায়াছবির বুপ নিয়া তাহার চোখের সামনে ভাসিয়া আসিতে লাগিল। বাপের বাড়ির গ্রামে পরী যখন ছেড়া ডুরে পরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইত, আর বিবাহের পর এখানে আসিয়া পিঠে বেণি দুলাই যা স্কুলে যাইত, তখনকার কথা। কত আদরে কত যত্নে তাকে সে মানুষ করিয়াছিল। সেই পরী যে আজ তাহার ভুবনের মুখের গ্রাস কড়িয়া নেওয়ার জন্য এমন ভাবে নিজের সর্বনাশ করিল এর আকস্মিকতা এর অসামঞ্জস্য সমস্ত রাত চাবুকে অভিভূত করিয়া রাখিল । বনমালীকে ভালোবাসিয়া, যৌবনেব অপরিতৃপ্ত অসম - ক্ষুধায় অথবা নেহাত ছেলেমানুষি খেয়ালে যে পরী এই নিদারুণ ভুল করিযা থাকিতে পাবে, চাবুব মনে ঘূণাক্ষরেও সে কথা উদিত হইল না। যাহার বিবাহ হইয়াছে, যে তিনবছর স্বামাব ঘর করিয়াছে, বিশেষ করি যা যে তাহার বোন, তাহার মধ্যে ও সব পাগলামি চাৰু কল্পনা করিতে পারে না। চল্লিশ বছরের জীবনে কাহারও মধ্যেই আতি তাত্যের চিহ্ন তো সে খুজিয়া পায় নাই। মতলব থাকে। যে দিকে যে ভাবে মানুষ পা ফেলুক, পিছনে মতলব থাকে। বনমালীর আটত্রিশ বৎসর বযস হইয়াছে। টাকা ছাড়া তার আর কী আছে যে তার টানে মেয়েমানুষ লক্ষ্যভ্রষ্ট হইবে ? মানুষটা একটু অদ্ভুত, একটু গভীর। প্রথম বয়সে মনে মনে সেও তাহাকে একটু ভয় করিত। মনে হইত। তাহার ভিতরটা কী কারণে মুচড়াইযা মুচড়াইয়া পাক খাইতেছে, তার বড়ো যন্ত্রণা। তখন বনমালী যুবক। তার মধ্যে সে তো তখনও কোনো আকর্ষণ আবিষ্কার করিতে পাবে নাই ! তার নৈকট্যকে, তার নিবাক আবেদনকে, তার দুচোখের গভীর তৃষ্ণাকে, সে যে কতবার অপমান করিয়াছে তার হিসাব হয় না। তার সঙ্গে কথা কহিবার সময়ও কি সব সময় সে পাইত ! তাহার কাছে মানুষ হইয়া পবী কি তাহাব মনের জোর এতটুকু পায় নাই ? অসহায় আক্লোশে থাকিয়া থাকিয়া চাবুব মনে হইতে লাগিল, এর চেয়ে সেই যদি সে সময় বনমালীর নিকট আত্মসমর্পণ করিত তাও ভালো ছিল, এ রকম বিপদ ঘটাইবার সুযোগ পরী আজ তাহা হইলে পাইত না। চাবুর জীবনে অন্ধ আবেগের স্থান ছিল না। সমস্ত জীবন তাহাকে সংসাবের এলোমেলো বিবুদ্ধ শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। প্রথম জীবনে তাহার লড়াই ছিল আভাবেব সঙ্গে আর গ্রামের দু-তিনটি যুবকের স্বভাবের সঙ্গে। বিবাহের পর তাহার লড়াই শুরু হইয়াছিল ধনসম্পদের পলাতক প্রবৃত্তির সঙ্গে আব্ব নিজেকে সামলাইয়া না চলার দূৰন্ত ইচ্ছার সঙ্গে। এর কোনােটাই সহজ ছিল না। পুরুষ অভিভাবকের অভাবে সম্পত্তির ব্যবস্থা করিতে তাঙ্কার যেমন প্রাণান্ত হইত, অবাধ স্বাধীনতার সঙ্গে পাগলা স্বামীকে খাপ খ, যাইতেও তাহার তেমনই অবিরাম নিজেকে শাসন করিয়া চলিতে হইত। হাতে টাকা, দেহে বুপ, মনে অতৃপ্ত যৌবন—এ রকম ভয়ানক সমন্বয় ঘটিয়াছিল বলিয়া সারাজীবন তাহাকে অনেক ভুগিতে হইয়াছে। চাবুর হ্রদায়ের কতকগুলি স্থান তাই ভয়ানক শক্ত। পরদিন সকালে সে নিজে গিয়া পরীকে ডাকিয়া তুলিল, কিছুই যেন ঘটে নাই। এমনিভাবে বলিল নে, ওঠ এবার। অনেক বেলা হয়েছে।