পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পদ্মানদীর মাঝি Գ Տ সারাদিন এই তীর ঘোষিয়া নীেকা চলিল। কেতুপুরের পদ্মায় যে নৌকাকে অত্যন্ত বৃহৎ মনে হইয়াছিল, এখন সেটিকে কুবেরের মোচার খোলা বলিয়া মনে হইতে লাগিল। পরদিন অপরান্ত্রে নোয়াখালি জেলার নারিকেল বৃক্ষপূৰ্ণ তীরভূমিতে নীেকা বাঁধা হইল। এদিকে কুবের কখনও আসে নাই, বিস্ময়ের সঙ্গে সে হােসেনকে জিজ্ঞাসা করিল, এই কি সমুন্দুর ? হােসেন একখানা ম্যাপ বাহির করিল। আঙুল দিয়া সে কুবেরকে চিনাইয়া দিতে লাগিল মেঘনার মোহানার দ্বীপগুলি-সিদ্ধিদ্বীপ, বিদীেদ্বীপ, সন্দ্বীপ, হাতিয়া প্রভৃতি। আরও পশ্চিমে মানপুরদ্বীপ, দক্ষিণ-শারাজপুর, বন্দােরাদ্বীপ। আর ওই যে ছোটাে ছোটাে বিন্দুগুলি দেখা যায় বাইশ নম্বর মোটা লাইনটার উপরে, ওগুলি মানিক দ্বীপপুঞ্জ। চিনিতে পারিতেছে কুবের ? আর ওই পুব-পশ্চিমের বাইশ নম্বর লাইন আর উত্তর-দক্ষিণের এই একানব্বই নম্বর লাইনটা যে বিন্দুতে পরস্পরকে অতিক্ৰম কবিয়াছে, এই বিন্দুটির কিছু উত্তর-পূর্বে ওই যে একটি সবুজ বিন্দু দেখা যায় ওর নাম ময়নান্দ্বীপ। জানে কুবের,-ওরই নাম ময়নাদ্বীপ ! আব ঘণ্টা দশেক নীেকা বাহিয়া তাহারা নোয়াখালির তীরভূমিকে পিছনে ফেলিবে, তারপর হাতিয়া ডাইনে রাখিয়া ধনমানিক দ্বীপ ছুইয়া, ধনমানিক দ্বীপ আর রাবনাবাদ দ্বীপের যোগবেখার সঙ্গে বিয়াল্লিশ ডিগ্রি কোণ করিয়া পূর্ব-দক্ষিণে নৌকা বাহিলে একদিনে ময়নাদ্বীপে পৌছানো যাইবে { কুবের ভালো বুঝিতে পারে না! হাঁ কবিয নকশাবি বেখা ও লেখাগুলির দিকে চাহিয়া থাকে। কে জানে ওর মধ্যে মধ্যে ডাঙা ও জলেব পার্থক্য কী কৌশলে আঁকা আছে, সে তো কোনো প্রভেদ বুঝিতে পাবে না ! দেখিযাই তাহা বোঝা গেল। সামনে একটা কম্পাস রাখিয়া সে হাল ধবিয়া বসিল, নীেকার ছযজন মাঝি টানিতে লাগিল দাড়। সাংবাদিন পরে রক্তিম সূর্য সমুদ্রেব জলে ডুবিয়া গেল, পুবে বহুদূরে কালো বিন্দুল মতো একটি দ্বীপ ছাড়া সূর্য শুধু দেখাইযা গেল আকাশ ও জলরাশি। রাত্রেও দাঁড় টানার বিবাম হইল না, পালা কবিঘা দুজন দুজন মাঝিকে দুঘণ্টা কবিয়া ঘুমানোব অবসর দিয়া চারজনকে হােসেন সবসময়ে বসাইয়া বাখিল দাঁড়ে, নিজে এক মিনিটেব জন্যও চোখ বুজিল না। নীেকাব সকলে হয়রান হইয়া গেল, কুবেরেব মনে হইতে লাগিল নীেকা বাহিয়া জীবনে সে আর কোনোদিন এত শ্রাস্ত হইযা পড়ে নাই। সকালবেলা দেখা গেল চাবিদিক নিবিড় কুয়াশায ঢাকিয়া ? “আছে। হােসেন বলিল, বইঠা থোও কুবিব, নোঙর ফেলো। এতখানি কাছি টানিয়া নোঙব সমুদ্রের তলে গিয ঠেবিল যে কুবেরেব মনে হইল নোঙরটা পাতালে গিয়া পৌঁছিযাছে। কুযাশায নৌকা চালাইবার উপায় নাই, ধনমানিক দ্বীপের কাছাকাছি তাহারা আসিয়া পড়িযছে, কুয়াশায় দেখিতে না পাইযা পাশ কাটাইয়া দূবে চলিয়া গেলে বিপদ হইবে ; এই দ্বীপটির অবস্থান দেখিযা। তবে ঠিক কবা। যাইবে বাবনাবাদ দ্বীপের সঙ্গে ইহার যোগারেখা, তারপব সোজা আগানো চলিবে কম্পাসের উপর নির্ভর করিয়া একেবারে ময়নাদ্বীপের দিকে। সারাদিন নীেকার অবস্থান বুঝিতে পাবা। যাইবে কি ন! শািন্দহ। অপেক্ষা করিতে হইবে রাত্রির জন্য। রাত্রে তারা উঠিলে ওই যে অদ্ভুত যন্ত্রটা আছে হােসেনের, ওই যন্ত্রের ভিতর দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া। তবে হােসেন বলিতে পরিবে যে দিকে কতদূরে ধনমানিক দ্বীপ লুকাইয়া আছে। কি জান মিয়া, কলের জাহাজ হলি, জানন যায় কত জোর চলতেছি, ঘণ্টায় কয় মাইল আলাম—-সমুদুরের কোনখানে রাইছি। হিসাব করলি মেলে। নাও চালাইয়া জানুম। কিবা ?--দাড়িতে হাত বুলায় হােসেন, সকলকে অভয় দিয়া আবার বলে, ডরাইও না, দশ বাজলি কুয়াশা থাকবে না। আইজ কাইল রোজ বিহানবেলা কুয়াশা হয়। অ্যাবে কি কুয়াশা কয় মাঝি ?