পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/২০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ミobr মানিক রচনাসমগ্র দুজনে তারা পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকে। রেণুর হাসিটা হয় একটু করুণ। আর লাজুক। রেণুর মধ্যে অল্প অল্প পরিবর্তন ধরা পড়ে সুনীলের কাছে। যেমন ওই করুণ ও লাজুক হাসি। এ হাসি সুনীল কখনও আর দ্যাখেনি। সেদিন বিশ্ৰী কলহ হয়ে গেলা-প্ৰায় অকারণেই। তাকে ছোটোলোক পর্যন্ত বলে বসিল রেণু। অথচ পরদিন দেখা হতে এমনভাবে নিজেই সে কথা শুরু করল যেন ও সব ঝগড়াঝাঁটি কিছুই তাদের মধ্যে ঘটেনি অথবা ঘটে থাকলেও যেন কিছুই তাতে আসে যায় না ! আগে রেণু অস্তুত জিজ্ঞাসা করত, রাগ করেননি তো ? কেমন একটা বিরক্তি আর খানিকটা বিদ্বেষের ভাব অনুভব করে সুনীল। মনে হয়, তাকে ভালোমানুষ পেয়ে রেণু যেন তাকে তুচ্ছ করছে, অবহেলা করছে। একদিকে গায়ে পড়ে ঝগড়া করে তাকে গাল দিয়ে ক্ষমা চাওয়াও যেমন সে দরকার মনে করে না, অন্যদিকে তেমনি আবার তাকে অনুকম্পা করে একটু আত্মীয়তা আর স্নেহ-মমতা দেখাতে চায়। সে যেন দুঃখী বঞ্চিত মানুষ, তার কাছে একটু দয়া পেলে খুশি হবে। নিজের সম্পর্কে পুরানো অস্বস্তিবোধটাও জোরালো হয়ে ওঠে সুনীলের। কেন এত চুলচেরা বিচার ? কী এমন আসে যায় রেণুর কথা ব্যবহার একটু এদিক-ওদিক হলে ? দীর্ঘকাল ধরে তাদের পরিচয়, পরস্পরের জন্য তাদের কোনো দুর্বলতা থাকলে এতদিন এত ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার পর তা কী গোপন থাকত ? বন্ধুত্বের সম্পর্কই তাদের গড়ে উঠে নিজস্বতা আর বৈশিষ্ট্য নিয়ে-প্ৰত্যেক বন্ধুত্বেরই যেটা থাকে। বন্ধুত্ব ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্কই সম্ভব নয়, তারা সেটা চায়ও না। কিন্তু তারা তো যন্ত্র নয়, মানুষ। যতই শক্ত আর সেন্টিমেন্ট-বর্জিত হােক, রেণু আবার মেয়েমানুষ, তার কথায় ব্যবহারে একটু এদিক-ওদিক ঘটলে সে কেন এমন অস্বস্তিবোধ করবে, সামান্য ব্যাপার নিয়ে এমনভাবে মাথা ঘামাবো ? মিলনীর সঙ্গে প্রথম থেকে কেন সে অবাধে প্ৰাণ খুলে মিশতে পেরেছে, এত অল্পসময়ে কেন তাদের ভাব জিমেছে ও মিলনীকে কেন এত ভালো লেগেছে তার কারণটা আবিষ্কার করে কয়েকদিন সুনীল অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিল। এতদিন জানা যায়নি। কিন্তু মিলনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠত জন্মানোর পর একটা ব্যাপার খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে যে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার নিজস্ব একটা পছন্দ-অপছন্দের নিয়ম দিয়েই সে বরাবর নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।--বেশ পাকাপোক্ত বুদ্ধিমতী মেয়েদের সঙ্গে মিশতেই সে পছন্দ করে, যার ছেলেমানুষি এবং ভাবুকত যত কম তাকে ততটা ভালো লাগে। এর মধ্যে বয়সের প্রশ্ন নেই, অল্পবয়সি কোনো মেয়ে যদি রেণু বা মিলনীর মতো বুড়িয়ে যেতে পারে, তার সঙ্গও সে পছন্দ করবে ! সে তো নিছক একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে ! এ রকম একটা ধরাবাঁধা নিয়ম নইলে পিছন থেকে তাব হৃদয়-মনকে কী করে নিয়ন্ত্রিত করে ? কিন্তু গ্লানিবোধ খুব তাড়াতাড়িই কমে গেছে সুনীলের। ক্ৰমে ক্ৰমে কয়েকদিনের মধ্যে তার কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে এটা তার যান্ত্রিকতা নয়, এটাই তার জীবনের বাস্তবতা।