পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/২৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

2 মানিক রচনাসমগ্ৰ এবার জগদীশ মুখ খোলে। তোমার। প্ৰণামি তো আমি নেব না। কেন বাবা, কী অপরাধ হল ? প্ৰণামির জন্য তুমি সোনা এনেছ ! জান না প্ৰণামি দিয়ে আমি কী করি ? হাভাতে-হাঘরে গরিবদের বিলিয়ে দিই। প্ৰতাপ কাতরভাবে বলে, কিন্তু সোনা দিলে কী দোষ হয় সেটা তো ঠিককাকে দেব সোনাটা ? সোনাটা ভাঙাতে গেলে গরিব বেচারাকে চোর বলে পুলিশে ধরবে না ? ক-টা ছাপা কাগজ আনিলেই হত, ক-জনকে দিতে পারতাম ! প্ৰতাপ হাতজোড় করে বলে, তাই নিন দয়া করে-সোনাটাও থাক। এটা বংশের নিয়ম, গুরুকে সাধুকে ব্রাহ্মণকে সোনা ছাড়া প্ৰণাম করলে অভিশাপ লাগবে। নিয়মটা নাকি চালু করে গিয়েছে প্ৰতাপের পিতাঠাকুর। যা ধরত তাই সোনা হয়ে যেত, গুরু তাই হুকুম দিয়েছিল টাকা-পয়সা শুধু ভিক্ষা দেওয়া চলবে-গুরুকে সাধুকে ব্ৰাহ্মণকে বা মন্দিরে সোনা ঠেকিয়ে প্ৰণাম না করলে হয়ে যাবে সর্বনাশ। প্ৰতাপ। ডাক দেয়, খুব মিষ্টিসুরে ডাক দেয়-ছোটাে বউমা, পাঁচ টাকার নোট দাও দিকি 吋问11 রংচংয়ে শাড়ি আর একরাশি গয়নায় জমকালো করে সাজা বিশ থেকে চল্লিশ পেরোনো বয়সের কয়েকজনের পিছনে ছিল ছোটো বউ ললিতা। নিজেকে স্বেচ্ছায় খানিকটা আড়াল করেছিল। সামনে এগিয়ে আসতেই তাকে দেখে জগদীশ চমকে ওঠে, কয়েক মুহুর্তের জন্য ভুলে যায় যে সে যোগী সাধক, তরুণী কোনো স্ত্রীলোককে দেখে বিচলিত হওয়াটা তার একেবারেই উচিত নয়। একটু বিহুল না হয়েও অবশ্য তার উপায় ছিল না। জলপ্রপাতে হারানো চিত্রা যেন উঠে এসেছে তার সামনে। শাড়িটা চিত্রার, চিত্রার মতোই তার দুহাতে দুগাছা শুধু চুড়ি। গায়ের রংয়ে সোনার চুড়ির এমন মিল যে মনে হয় চিত্রার মতোই এই কারণেই সে বুঝি অঙ্গ থেকে বিসর্জন দিয়েছে। আভরণের চিহ্নটুকু। চিত্রার ছাঁচে ঢালা গড়ন। সেকেলে উথলানো গড়নটা যথাসম্ভব চাপা দেবার জন্য ঠিক চিত্রার মতোই আধুনিকতম সাজসজার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তবে মুখ একেবারে অন্য রকম। তার মুখ দেখে জগদীশ স্বস্তি পায়। চিত্রার মুখের সঙ্গে শুধু রঙের মিল ছাড়া কোনো মিল নেই। ললিত্য আছে, কোমলতা আছে, লাবণ্য আছে-কিন্তু সবই যেন আছে মুখের তীক্ষ্ণ কাঠিন্যকে খানিকটা আড়াল করে যতটুকু না রাখলে নয় শুধু ততটুকু মেয়েলি ভাব বজায় রাখার জন্য। চোখে শাস্ত সজাগ দৃষ্টি-বুদ্ধির ধারে শাণিত। পাঁচ টাকার পাঁচটি নোিট গুনতে গুনতেই ললিতা একবার শাণিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে G ! তাকে ঠোঁট কামড়াতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে জগদীশ সামলে নেয়। একটু হতভম্ব প্ৰতাপকে সে গভীর উদাত্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, এই পরম ভাগ্যবতী মা-টিকে তুমি কোথায় পেলে ?