পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/২৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুর্থ অধ্যায় জগদীশ শহরে আসবে প্ৰতাপের বাড়িতে পদার্পণ করবে। শুধু প্ৰতাপের বাড়িতে নয়, আরও অনেকের বাড়িতে উৎসাহ-উত্তেজনা দেখা যায়। পাহাড়ের উচু শহর। দাৰ্জিলিংয়ের সঙ্গে তুলনা হয় না। কিন্তু শীতের আমেজ শুরু হতে না হতেই যেন সকালসন্ধ্যায়। শীত জোরালো হয়ে ওঠে। অকাল বর্ষা নামলে তো কথাই নেই। হাড়কাপানি ঠান্ডা পড়ে। সকালে জগদীশ আসবে। রাত্রে শুরু হল বৃষ্টি। যার জের চলল সকালেও। সকলে হতাশ হয়ে ভাবল, এই আবহাওয়ায় জগদীশ কি আর আসবে ? গাড়ি পাঠাতে জগদীশ নিষেধ করেছিল। তবু প্ৰতাপ ভোর রাত্রে গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। মনিব নিজে ডাকতে এলেও মাইনে করা ড্রাইভার নন্দ বালিশ থেকে মাথা পর্যন্ত তোলে না, বলে, আজ্ঞে আমার জুর হয়েছে, গায়ে-হাতে ভীষণ ব্যথা।। ভাগিনী-জামাই আশ্রিত তরুণকে দিয়েই অগত্যা গাড়ি পাঠাতে হয়। তরুণকে গাড়ি চালাতে দিতে ভয় করে। স্পিন্ডের দিকে ওর এমন বিশ্ৰী রকম বেঁটাক যে কবে কখন সৰ্বনাশ ঘটিয়ে বসে ভাবলেই বৃৎকম্প হয়। ভোর রাত্রে পাহাড়ি উচুনিচু রাস্তায় সে কী স্পিডে গাড়ি চালিয়ে জগদীশের আশ্রম ঘুরে ফিরে আসে, অনায়াসে টের পাওয়া শুধু তার যাতায়াতের সময়ের হিসাব কষে। যাই হােক, অক্ষত গাড়িটা নিয়ে জীবস্তু মানুষটা যে ফিরেছে তাই ঢের। কিন্তু ব্যাপার কী ? খবর কী ? আশ্রমে পৌঁছে তরুণ শুনতে পায় এই জল-ৰাদলার শীতের মধ্যে রাত তিনটেয় জগদীশ গোরুর গাড়িতে শহরে রওনা হয়েছে ! ফিরবার পথে তরুণ নাগাল ধরেছিল গোরুর গাড়িটার। গাড়ি থামিয়ে জগদীশকে বলেছিল, এখনও তো আন্দেক রাস্তা বাকি। আমার গাড়িতে নেমে আসুন, চটপট পৌঁছে যাবেন। ছাঁইয়ের নীচে খড়ের বিছানায় আধ-শোয়া জগদীশ মাথা তুলেও তাকায়নি। বেশ যাচ্ছি। ঢাকাস-ঢকাস করে। ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব। সকলকে গরম জামা-চাদর বার করতে হয়েছে, গায়ে চাপাতে হয়েছে অকাল বর্ষার অস্বাভাবিক শীতে। জগদীশ গোরুর গাড়ি থেকে নামে খালি গায়ে আলগা একটা পাতলা সুতির চাদর জড়িয়ে। গাড়ি চালিয়ে এনেছে জিরাই। তার গায়ে মোটা নিরেট চটের মতো বুনো সুতির চাদর। সবাই ব্যাকুল হয়ে ভাবে যে এই কনকনে ঠান্ডীয় জগদীশ উড়ানি গায়ে দিয়েছে, এটা কি বাহাদুরি দেখানো ? সুদৰ্শনা সবার আগে মুখ খুলে প্রশ্ন করে, এর কোনো মানে হয় ? ঠান্ড লেগে অসুখ করবে না ? জগদীশ হাসিমুখে তাকে অভয় দিয়ে বলে, যার কোনো সুখ নেই, তার কখনও অসুখ হয় ? সকলে ভয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে। হ্যা, একটা গুজব তারা শুনেছে বটে। রক্তজমাট করা খাঁটি শীতের রাত্রি। বনের রাত্রিচর হিংস্র পশু পর্যন্ত আশ্রয়ে মুখ গুজে আছে।