পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/২৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যষ্ঠ অধ্যায় উদভ্ৰান্ত জীবন কি এনে দিয়েছে। উদভ্ৰান্ত চিস্তা আর অনুভূতি ? মাঝে মাঝে জগদীশের এমন উদ্ভট মনে হয় নিজেকে এবং জীবন ও জগৎকে ! বড়ো বড়ো কথা আজও সে ভাবে, সূক্ষ্ম চিস্তা করতে পারে-সব সময না হলেও। বড়ো কথা, সূক্ষ্ম কথা বলে জ্ঞানী অভিজ্ঞ বিষয়ী এবং বয়স্ক ভদ্রলোকদের ভক্তে পরিণত করতে পারে। জগদীশ জানে ধন-মান বৃপযৌবন শিক্ষাদীক্ষা অনেক কিছু বাতিল করে বনবাসী হয়েছে বলেই শুধু নয়-এ সব ওদের শুধু টেনে আনে তার কাছে। কিন্তু তেজ আর কথার জোরেই সে ওদের স্থায়ীভাবে বশ করেছে। নইলে বনবাসী সাধু বলে দর্শন করতে এসে প্ৰণামি দিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করেই ওরা যথেষ্ট হয়েছে ভেবে বিদায় নিত--- দু-একজন ছাড়া আর আসত না। কিন্তু মানে কী সব কিছুর ? তার প্রেমের মানে ? জীবনের মানে ? বুনো মানুষগুলির বঁাচার মানে ? শহরের মানুষগুলির জীবনের মানে ? বনে আত্মহত্যা করতে এসে ধীরে ধীরে তার সাধু হয়ে ওঠার মানে ? অতল নিউটন এক নতুন হতাশা ঘনিয়ে আসে-যা ভাবাবেশের হঠকারিতায় চিত্রাকে জলপ্রপাতে বিসর্জন দেওয়ার চেয়ে যেন ভয়ানক ! আরও কড়া ব্যথায় যেন ঢের বেশি টনটন কবে যুদয়-মন ! নেশার ঘুম কিছুতেই আর রাতভোর টানা চলছিল না। ভোর হবার অনেক আগে, ব্ৰাহ্মা মুহূর্তের অনেক আগে ঘুম ভেঙে যায়। একবারমাত্র সে চেষ্টা করেছিল আবার নেশা চড়িয়ে ভাঙা ঘুম জোড়া দিয়ে আবার একটু ঘুমিযে ব্যথার বাতটা পোহাতে। পরদিন প্ৰায্য বিকাল পর্যন্ত দেহমানের অকথ্য বীভৎস যন্ত্রণা তাকে নিজের শরীরের রক্তবাহী শিরা চিলে দেবার অথবা আমগাছেব ডালে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়বাব জন্য উতলা করে তুলেছিল। সেই থেকে এমন আতঙ্ক জন্মে গিযেছে যে রাত দুটোয় নেশান ঘুম ভেঙে গেলেও সে আর ঘুমোবার কৃত্রিম চেষ্টার ধার ঘেঁষে না। ভাবে আর বই পড়ে। সে রাত্ৰে কুঁড়েতে বই ছিল মাত্র একখানা -- তরুণের লেখা প্ৰথম কবিতার বই ‘ভারতের (2Körgi ' নিজেই পয়সা খরচ করে ছাপিয়েছে, বোধ হয় পাসের জোরে বিয়ে করে পাওয়া পয়সায়। সকলে নিন্দা করলেও বইটা খুব বিক্রি হয়েছে-হয়তো সকলের বেশি বেশি নিন্দ করার জন্যই। ওই বইখানা ছিল। তরুণ আত্মার প্রচণ্ড আর্তনাদের কান্নায়-ভরা বীভৎস মর্মস্তিক বই-সুন্দরের কল্পনায় রঙিন জীবনকে দাঁতে-নখে ছিড়ে ফেলে দেহেব রক্তমাংস নীড়িতুড়ির স্বৰূপ দেখিয়ে জীবনকে অতি-বাস্তব আর সুন্দরকে মৃদুতা মিষ্টতা বর্জিত ভীষণরূপে দেখাবার জন্য লেখা বই। আর ছিল ঠোঙার কতগুলি টুকরো। আদিম জঙ্গলের প্রান্তে তার এই বুনো কুঁড়েঘরেও শহরে ছাপানো খবরের কাগজের টুকরা দিয়ে তৈরি করা ঠোঙা পৌঁছে গেছে। জগদীশ পর্যন্ত টের পেয়ে জেনে গিয়ে আমোদ বোধ করেছে যে খবরের কাগজের দৈহিক গতির পরিণতি মুদিখানায় মাল বেচার ঠোঙায়।