পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/৩০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Cor মানিক রচনাসমগ্ৰ পেতে দ্যাখেনি। আজ তার মুখ লাল হয়ে যেতে দেখে জগদীশ একটু হাসে। বলে, তোমাদের একটা কথা বলব, আমার বিনয় ভেবো না। আমিও সংসার ছেড়েছিলাম, রতনও ছেড়েছিল। ওটা স্টাটিং পয়েন্ট ধরে হিসাব করলে দেখা যাবে রতন অনেক নতুন চিন্তা আর অভিজ্ঞতার খোরাক পেয়েছে, আমি পেয়েছি সামান্যই। রত্নাকর বলে, কী যে বলো তুমি দাদা ! তোমার সঙ্গে আমার তুলনা ! সুদৰ্শনা বলে, আপনি সত্যি বিনয় করে এটা বললেন--কিংবা তামাশা করলেন ! জগদীশ বলে, না না, কথাটা সত্যি। এটা বুঝবার পরেই অনেক ব্যাপার। আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। বনে গিয়ে হাজার বছর চিন্তা করেও কেউ জ্ঞান বাড়াতে পারে না। আমিও পারিনি। দুজনে সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। সংসার ছাড়ার সময় হয়তো রতনের চেয়ে আমার জ্ঞানবুদ্ধি অভিজ্ঞতা বেশি ছিল, এখনও হয়তো রতন চিন্তার ওজনের হিসাবে আমার সঙ্গে পান্না দিতে পারবে না-আমি সে কথা বলছি না। আমি বলছি নতুন চিস্তার কথা, জ্ঞান বাড়ার কথা। এখানে পালিয়ে আসার পর আমি কতটুকু নতুন চিন্তা পেয়েছি, কতটুকু জ্ঞান বেড়েছে ? এতকাল একা এক দিনরাত ভেবে ভেবে আমি কী করেছি ? আগে সঞ্চয় করা এল্লোমেলো চিন্তাগুলি শুধু ঝেড়ে-কুঁকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছি, মিলিয়ে নিয়েছি, যোগ-বিয়োগ করে কী দাঁড়ায় বার করেছি। তাছাড়া উপায় ছিল না। মানুষকে ছেড়ে জঙ্গলে এসে একলা হওয়া মানেই মনের ভঁড়ারে ঢুকে ভেতর থেকে খিল এটে দেওয়া-ভঁড়ারে যা ছিল তাই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা। আনকোরা নতুন চিস্তা আসবে কোথা থেকে, জ্ঞান বাড়বে কী করে ? ভবঘুরে হয়েও রতন থেকেছে মানুষের মধ্যে, নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা কুড়িয়েছে, নতুন চিন্তা মনের ভঁড়ারে তুলেছে। সুদৰ্শনা প্ৰায় কাতরভাবে বলে, তবে কি বলছেন আপনার সাধনা নিৰ্ম্মফল হয়েছে, নতুন কিছুই পাননি ? জগদীশ বলে, নতুন কিছু না পেলেও জঙ্গলে আসা নিস্ফল হয়েছে বলব না। এ রকম একলা হয়ে দিন না কাটালে এলোমেলো খেই হারানো চিন্তার যে স্তুপটাি জন্মেছিল সেটা ঘাটা হত না, যাচাই করে করে জঞ্জাল সাফ করা হত না, মিলিয়ে জোড়া দিয়ে আসল ভাবনাগুলি স্পষ্ট করা যেত না। এদিক দিয়ে বনে আসা নিস্ফল হয়নি। তবে আত্মচিন্তার সুযোগ মিলেছে। জগদীশ একটু হাসে। আগে বুঝতাম না তোমরা কেন আমার কথা শুনে খুশি হও-বতন আমায় ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছে। আত্মচিন্তাও সাধনা বইকী, চিস্তার জট ছাড়ানো কী সহজ ব্যাপার । নতুন চিস্তা না জুটুক, চিস্তার জট ছাড়িয়েছি। এই সাধনাকে তোমরা সম্মান করো। তোমরা এলোমেলো চিন্তায় হাবুডুবু খাও, আমি চট করে আসল কথাটা ধরিয়ে দিতে পারি। রত্নাকর সোৎসাহে বলে, দাদা, বলিনি তোমায়, সংসার কাউকে ছাড়ে না, নিজের দরকারে ছুটি দেয় ! হাড়েহাড়ে এটা আমি টের পেয়েছি। সংসার বলে, তুমি পাগলাটে, মানিয়ে চলতে পারছে নাযাও খুশিমতো মন্দির থেকে আঁস্তাকুড় ঘটবে যাও, খুশিমতো চিন্তা করবে যাও, তোমার ছুটি মঞ্জুর। আমরাও জানতে বুঝতে চাই-কিন্তু আমাদের সময় কই, সুযোগ কই ? যখন কিছু জানতে বুঝতে পারবে, আমাদের জানিয়ে বুঝিয়ে দিয়ো ! জগদীশ হাসিমুখে সায় দিয়ে বলে, এবার বুঝলি তো আমার চেয়ে নতুন চিন্তা তুই বাড়িয়েছিস ঢের বেশি ? এলোমেলো নতুন চিন্তা নতুন অভিজ্ঞতার পাহাড় দিয়ে কী হয় ? শুধু জমানো চিন্তার জট ছাড়িয়ে নিলেই বা কী হয় ?