পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/৩২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লাজুকীলতা তমাললতার লজ্জার বহর দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। এ যুগে শহরবাসী শিক্ষিত একটা মানুষের বউ যে এমন লাজুক হতে পারে এ যেন ধারণাই করা যায় না । তমাল নিজেও নাকি কিছুকাল স্কুলে যাতায়াত করেছিল ! শ্বশুর শাশুড়ি গুরুজন নেই, বছর পাঁচেকের একটি ছেলে আর তিন বছরের একটি মেয়ের মা, তবু সব সময় সে যেন লজ্জায় জড়সড় হয়ে থাকে, নিজেকে মানুষের চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে পাবলেই সে যেন বঁাচে । বীরেনের দোতলা বাড়ির একখানা ঘরে সম্প্রতি তারা শহরের অন্য এলাকা থেকে উঠে এসেছে। বাড়িতে ঘর ভাড়া দেবার কোনো প্রয়োজন বা ইচ্ছা বীরেনের ছিল না। যতীনের উপর এটা তার অনুগ্রহ দেখানেই বলা যায়। বীরেনের বড়োছেলে হেমাঙ্গের সঙ্গে যতীনের পরিচয়ের সুযোগে এই সুবিধাটুকু যতীন আদায় করেছে। একটা ঘর ভাড়া নিয়েই সে বাস করছিল শহরের অন্য এলাকায় এবং ভাড়াটে নিয়মিত ভাড়া দিয়ে ঘর দখল করে থাকলে তাকে উঠিয়ে দেবার ক্ষমতাও বাড়িওলার থাকে না।--তবু কেন যে সে ওই ঘবখানা ছেড়ে দিয়ে বিপন্ন হয়ে এ বাড়িতে আরেকটি ঘর ভাড়া নিয়ে উঠে এল, হেমাঙ্গও ভালো বুঝতে পারেনি। বিপন্ন বন্ধুর প্রতি এই দয়া প্রদর্শনে বাড়ির লোকেরা মোটেই খুশি হয়নি হেমাঙ্গের উপর। বন্ধুত্ব ছিল কেবল হেমাঙ্গ ও যতীনের মধ্যে, এ বাড়িতে ভাড়া করে উঠে আসার আগে তমালকে কেউ দেখেনি। তাকে দেখে বরং তাদের মুখ বেশ গভীর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তমাললতার ভীরুতা ও লাজুকতার বাড়াবাড়িতে অনেকে তাজব বনে গেলেও মুখের অন্ধকার অনেকটা কেটে গিয়েছে বাড়ির লোকের। বীরেনের বড়ো মেয়ে সুচারুকে তার স্বামী নেয় না। সে অবশ্য মুখ বাঁকিয়ে বলে, ঢং ! বলে, মাগির সব ন্যাকামি আর বিজাতি। অত লজ্জা কেউ দেখায় না, উনি তাই বেশি করে। লজ্জা দেখিয়ে দশজনের নজর টানেন। এ যেন বুঝতে দেরি লাগে কারও। আমার বুড়ো ব্যাপকে দেখে তুই কোন লজ্জায় আধহাত ঘোমটা টানিস ? কিন্তু বাড়ির এবং পাড়ার বুড়োবুড়িরা পছন্দ করে তামালোব প্ৰায় বেহায়াপনার মতো লাজুকপনা। এ রকম চালচলনই তো মানায় গোরস্তঘরের জোয়ান বয়েসি বউয়ের। মুখে রা নেই, ফন্টাংফটাং যখন তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পাড়া চষে বেড়ানো নেই, পুরুষকে তফাতে রেখে আড়ালে রেখে চলায় এতটুকু টিল নেই। হেমাঙ্গের সঙ্গে সে নাকি আগে কথা বলত। হেমাঙ্গ তারই জের টেনে তার সঙ্গে দু-চারবার কথাবার্তা বলবার চেষ্টা করেছে—কিন্তু তমাল মুখ ফেরায়নি, মুখ খোলেনি। ছেলেকে দিয়ে হেমাঙ্গের কথার জবাব দিয়েছে। হেমাঙ্গের বুড়োবুড়ি মা-বাপ ফেলেছে স্বস্তির নিশ্বাস।