পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/৩৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Svo মানিক রচনাসমগ্র কিন্তু হেমাঙ্গের কলেজে পড়া ছোটােবোন সুমায়া বলেছে, তোমরাও যেমন ! এ রকম উদ্ভট খাপছাড়া রকমসকম দেখে কোথায় আরও ভড়কে যাবে, তোমরা খুশি হয়ে উঠলে ! বুড়ি সুভদ্রা বলে, তুই বুঝবিনে। তুই কেবল একপেশে বিচার শিখেছিস। খাপছাড়া বটেই তো, এ রকম খাপছাড়া লজা কোনো বউয়ের দেখা যায়। আজকাল ? কিন্তু একটা খাপছাড়া অবস্থায় পড়েছে বলেই নিশ্চয় এ রকম খাপছাড়াভাবে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। তুই তলিয়ে সব জেনেছিস ওদের ভেতরের ব্যাপার ? না জেনেই চটাংচটাং কথা কইছিস। আমরা টের পেয়েছি। তাই আমরা বলছি, বেশ করছে। কী টের পেয়েছ ? সে তুই বুঝবিনে, অত কথায় তোর কােজ নেই। যতীনের অনেক দিন চাকরি নেই খবর রাখিস ? দেখায় যেন চাকরি করে, কিন্তু আমরা টের পেয়ে গেছি। সাধে কি ঘর ছেড়ে বন্ধুর বাড়ি ঘর ভাড়া নিয়েছে ? সেখানে ভাড়া বাকি পড়লে মালপত্র আটক রেখে খেদিয়ে দিত। বন্ধু তো আর তা পারবে না। মানুষটা মরিয়া হয়ে উঠেছে-বউটা নিজেকে বঁচিয়ে চলবে না ? সুমায়া হঠাৎ যেন বিদ্যুতের ঝলকানি চেয়ে দেখেছে। এমনিভাবে চোখ পিটপিট করতে করতে বলে, ও ! যতীন একটু ঝাঝালো হাসির সঙ্গেই বলে, ভবেশবাবুর মা ডেকে তোমার প্রশংসা শোনালেন। তোমার মতো খাঁটি বউ নাকি পাড়াতে আর নেই। তা, কথাটা সত্যি। ওনার নাতিবউয়ের সঙ্গে তুলনা করলে সত্যি তোমার তুলনা মেলা ভার ! কালো টানা চােখ তুলে ঝিলিক মেরে চেয়েই তমাল চােখ নামায়। পাতলা ঠোঁটের অপূর্ব কারসাজিতে একটু রহস্যময় হাসিরও ঝিলিক খেলিয়ে দেয়। যতীন সারাদিন চাকরি এবং রোজগারের সন্ধানে টোটাে করে ঘুরেছে। দেহমান দুইই তার শ্ৰান্ত এবং ক্লান্ত। মুখটা যেন স্থায়ীভাবে বেঁকেই আছে। হতাশায় মন বঁকা হয়ে যাওয়ারই বােধ হয় এটা প্রকাশ্য লক্ষণ। কেবল চাকরি করার অধিকার নয়, সংসারের কোনো অধিকার খাটাবার ক্ষমতাই যেন তার নেই। বউটা পর্যন্ত তার হুকুম মানে না। মুখ আরেকটু বঁকিয়ে সে বলে, সেদিন নীরেনবাবুও বলছিলেন, তুমি তো ভাগ্যবান পুৰুষ যতীন ! এই ভেজালের যুগে খাঁটি সহধর্মিণী পেয়েছ। চুলদাড়ি সব সাদা হয়ে গেছে, নইলে একটা চাপড় কষিয়ে দেবার কথা ভাবতাম। গামছা লুঙ্গি হাতে দিয়ে। তমাল মৃদুস্বরে বলে, ভবেশবাবু নীরেনবাবুদের বলো না একটা চাকরি জুটিয়ে দিক। পাড়ার একমাত্র খাঁটি বউটর যে সিঁদুর কেনার পয়সা নেই ? যতীন সচকিত হয়ে তার মুখের ভাব দেখবার চেষ্টা করে। সত্যই কী এমন তীব্র তীক্ষ রসিকতা করছে তমাল অথবা আপনা থেকে বেরিয়ে এসেছে কথাগুলি তার মুখ দিয়ে ? কিন্তু ইচ্ছা বা প্রয়োজন হলেই তামালের মুখ দেখা অত সহজ ব্যাপার নয়। তার স্বামীর পক্ষেও। কথা বলতে বলতে তমালা নত হয়ে মাথা নামিয়ে তার জুতোজোড়ার ধুলো ঝাড়তে শুরু করেছিল। পুরানো হয়ে গেছে ভালো দামি জুতোজোড়া-একটা প্ৰায় সুনিশ্চিত চাকরির আশায় মরিয়া হয়ে কেনা হয়েছিল। এবার ছিড়ে যাবে। তবু এই জুতো পায়ে দিয়েই কাল আবার তাকে বার হতে হবে চাকরির খোঁজে। হেমাঙ্গ গিয়েছিল বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখতে। সে বাড়ি ফেরে রাত নটার পর। যতীন খেয়ে উঠে চৌকির বিছানায় বসে পান চিবোতে চিবোতে মেঝেতে ছেলেমেয়ের বিছানায় মশারি খাটিয়ে গুজে দেওয়ার কাজে-রত তমালকে দেখছিল।