পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

vov মানিক রচনাসমগ্ৰ শুধু ময়লা জামাকাপড়-পরা বা অর্ধ উলঙ্গ গরিব মানুষের ভিড় নয়। ফিটফাট বেশধারী বাবু মানুষ, সুটপরা সাহেব মানুষ এবং ভালো শাড়িপরা ভদ্রমহিলাও এই পথে হাঁটছে, দুপাশের দোকানে কেনাকাটা করছে। খানিক এগিয়েই সিনেমা। শো চলছে, ভিতরটা বোঝাই, তবু বাইরে গিজগিজ করছে সব বয়সের ভদ্রাভদ্র মেয়ে পুরুষ। পরের শো-র টিকিটের প্রয়োজনে এত আগে এসে ধন্ন দিয়েছে। চেনা মানুষ। শুধায়, আজ সকাল সকাল ? কেশব বলে, ছুটি পেয়ে গেলাম। অফিস করা শ্রাস্ত চেনা মানুষ মন্তব্য করে, তোমার তো ভাই আবামের চাকরি । পরের মোটরে চেপে বেড়াও, খেয়ে-দোয়ে খাটিযায় শুয়ে নাক ডাকাও। কেশব মুখ বাঁকায়। করে দেখলে আরাম টের পাওয়া যায়। বাবু সুকুম দেবে, জোরসে চালাও। জোরসে চালিয়ে মানুষ চাপা দিয়ে তুমি শালা মার খাও আর জেলে যাও। কত আরাম ! এগোতে এগোতে আরও কমে আসে রাস্তার আলোর জোর, দোকানপাটের দেখা মেলে দূরে দূরে, বাড়িগুলির গ্রাম্যতা আর জীৰ্ণতা বেড়ে যায়। এবড়ো-খেবড়ো খোয়ায় তৈরি এই প্রধান রাস্তা থেকে দুপাশে পাড়ার মধ্যে ঢুকে গেছে ইটের গালিগুলি। বাগদিপাড়ার ফাঁকা জায়গায বাজারটা খা-খ্যা করছে দেখা যায়। এখানে সকালে একবেলা বাজার বসে। বোসপাড়ার মোড়ে বিবৰ্ণ থামিটার মাথায় টিমটিম করে জুলছে একটা অল্প পাওয়ারের বালব। এ যেন বঁাশঝাড় ডোবা-পুকুর এলাকার মানুষগুলিকে জানিয়ে দেওয়া বৈদ্যুতিক আলো জুললেই কী এসপ্ল্যানেডের মতো আলোয় ঝলমল করে ?--এটাও বৈদ্যুতিক বাতি, এদিকে তাকিযে ঘবের ডিবেরি আর লণ্ঠন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো। সন্ধ্যাদীপ জুলো ভেজাল তেল দিয়ে, ছোড়া ন্যাকড়ার সলতে পাকিযে। সে আলোতে শাস্তি আছে, স্নিগ্ধতা আছে ! এটা তো নিছক কাচের খেলনার আলো । কেশব একটু দাঁড়ায়। এখন মনে হয়, কত দূরে যেন ভেসে এসেছে লেভেল কৃসিংয্যের ও পাবে ললনাদের শহর, মন থেকে যেন প্ৰায় মুছে গেছে চোখ-কািলসানো আলো, শহবের জমকালো বৃপ আর গাড়ি ও মানুষের কলরব। সে-ও ওই ধোঁকালজিতে বিশ্বাস করে-সভ্য জগতের সভ্য জীবনের কোলাহল থেকে দূরে পালিয়ে শাস্তি ও স্নিগ্ধতা খোঁজার ধোঁকাবাজিতে । নইলে ললনার অতি আগ্রহ সত্ত্বেও সিনেমা শো-টা শেষ পর্যন্ত না দেখে কীসের আকর্ষণে সে ছুটে এল এই আধা-অন্ধকার ডোবাব সেঁন্দা দুৰ্গন্ধে ভারী বাতাসের গেয়ো এলাকায় ? শরতের মনোহারি ও মুদিখানা মেশানো দোকানের বালািবটা জোরালো আলোই দেয়। কেশব দোকানে দুপয়সাব নস্য কিনতে যায়। ন্যস্য দিয়ে শরৎ তার হাতে একটা ঠোঙা দেয়, বলে, গুড়টা বাড়িতে পৌঁছে দেবে ? ছোড়ার্টুড়িগুলি কী মিষ্টিটাই খেতে পারে !! প্রৌঢ় শরতের মুখে একটা শান্ত নিরুত্তেজ ভাব, জীবনে তার যেন কোনো রসকষ নেই। স্থানীয় স্কুলে বাংলা পড়ায় আর এই দোকানটা চালায়, নীরস একঘেয়ে হয়ে গেছে ৩ার জীবনের লড়াই। শরতের দোকানের পাশ দিয়ে কেশব দক্ষিণ দিকে বোসপাড়ার রাস্তায় ঢোকে। বোসপাড়ায় ছাড়া ছাড়া থোক থোক ঘন বসতি। কাছাকাছি ঘেঁষাৰ্ঘেষি হয়তো আট-দশটি বাড়ি, তার পরে খানিকটা ফাঁকা মাঠ পুকুর বাগান ঝোপ জঙ্গল।