পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/৩৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

बाश्रित घात সকালবেলা সদানন্দ রেশন আনতে বেরিয়েছে। গোমড়া মুখটা যেন রাগে আর গায়ের জ্বালায়। থমথম করছে। একটা ব্যাঙচিকে ছেড়া চটি-পরা পায়ে থেতলে৷ থেতলে এমন করে মারো যেন লাথি মেরে মাথা ভাঙছে, কোনো অসহায় বিপন্ন শত্ৰুর। রোয়াকে উবু হয়ে বসে গায়ের জ্বালায় জোরে জোরে বিড়িতে টান দিয়ে কাশছিল লক্ষ্মীপতি। সে কাশতে কাশতে প্রশ্ন করে, নতুন কোনো আইডিয়া নাকি আনন্দদা ? রাস্তার কাল থেকে জল-ভরা বালতি দুটো দুহাতে ঝুলিয়ে আসতে আসতে হাঁপ ছাড়বার জন্য বালতি দুটাে রাস্তায় নামিয়ে হাঁপাচ্ছিল রোগা রুগণ মাঝবয়সি রমানাথ। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে, নতুন রকম কিছু নাকি ? হাসতে হাসতে পেটাটা ফাটাবেন না যেন বলে রাখছি আনন্দদা। রাত তিনটেয় উঠে পড়ছিল গোপাল। পরীক্ষায় পাস করবে না জেনেও পড়ছিল। উনানের ছাঁই কপূর আর পটাশ পারম্যাঙ্গানেটের ঘন রঙিন জলে গুলে কাদা করা খড়ি মাটির ঘরোয়া সস্তা খাঁটি স্বদেশি পেস্ট দিয়ে বিলাতি ব্রাশের সাহায্যে দাঁত মাজতে মাজতে সে সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। বলে, সকালবেলা২। নতুন আইডিয়া মাথায় এসেছে ? ইউ আর এ বেটার ভাড় দ্যান গোপালভাড় अन्मिन्थी ! তার গালে একটা চাপড় কষিয়ে দেওয়া উচিত ছিল সদানন্দের। কিন্তু চটবার উপায় তো তার নেই। সে কখনও চটে না বলে, সব সময় হালকা হাসি তামাশা নিয়ে সকলের সঙ্গে ইয়ার্কি ফাজলামি করে জীবনের দুঃখদুর্দশার দিকটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় বলে অনেকে তাকে রীতিমতো হিংসা করে। এ তো সহজ ক্ষমতা নয়। আজকের দিনে একটা সংসারী মানুষের পক্ষে ! সে তাই ভাড়ামির সুরেই বলে, সহজে কী হতে পেরেছি রে ভাই ! ভঁড়ামির পরীক্ষায় ফেল করতে করতে বেটার ভাড় হয়েছি। ! গোপালের মুখ লাল হয়ে যায়। কিন্তু অন্য সকলে হাসে। লোকে সত্যই আশ্চর্য হয়ে যায়। যে দিনকাল, যে অবস্থা মানুষের, সামান্য উপার্জনে সংসার চালিয়েও কী করে। সদানন্দ জীবনটা এমন হালকাভাবে নিতে পারে ! কেউ কেউ বলে, গায়ে একদিন ছুচ ফুটিয়ে দেখলে হত ব্যথায় মুখ বঁকায় কি না ! বুদ্ধিমানেবা বলে, কী বুদ্ধি তোমাদের ! মনটা হাসিখুশি রাখার সঙ্গে শরীরের কী সম্পর্ক ? যোগী সাধক মানুষ-সর্বদা আনন্দে থাকে। তাই বলে দেহে যন্ত্রণা হলে কাতরাবে না ? এই নিয়েও মতবিরোধ আছে। কেউ তাকে বলে যোগী সাধক, কেউ বলে ভঁড়। দু-চারজনে পাগলও বলে থাকে ! রেশনের দোকানে দাঁড়িয়ে সে ভয়ার্ত সুরে সকলকে জিজ্ঞাসা করে, হঁয়া মশায়, আপনারা আমাকে দেখতে পাচ্ছেন তো ? আমি আছি তো ? এ যে তার নতুন তামাশার ভূমিকা সবাই তা জানে। সকলে মুচকে হাসে। সকালবেলা ঈশ্বরের নাম করতে গিয়ে বড়োই খটকা লেগেছে মনে। ঈশ্বর আছেন কী নেই আমি তা নিয়ে মাথা ঘামাই না মশায় ! মুশকিল হল, আমি আছি কী নেই সেটা যে শুধু ঈশ্বর জানেন ! আমি তবে জানব কী করে ? মহা ভাবনায় পড়ে গেছি। তাই।