পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ফেরিওলা S এই সরু প্যাসেজটুকু দিয়ে সকলের আনাগোনা। শিল-ধোয়া জলে পায়ে পায়ে আনা ধুলোময়লার কাদার মধ্যে বসে পড়ে মা-কে দুহাতে বুকে জড়িয়ে শূভা বলে, অমন কোরো না মা ! আমরা কী আগের মতো বোকাহাবা স্বার্থপর আছি, তোমার কষ্ট বুঝব না ? কী করি বলো চোখ মেলে মেয়ের কোল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একটু বিহুলের মতন মোহিনী বলে, মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল। কী হয়েছিল রে ? কী বলছিস তোরা ? পরীক্ষণে সে যেন খেপে যায়। গলা ফাটিয়ে বলে, তুই যে হারামজাদি কাচা কাপড়টা পরে জলকাদার মধ্যে বসে পড়লি ? কে আবার কাচবে তোব কাপড় ? সাবান সোডা কে জোগাবে ? বলতে বলতে সে আবার চোখ বুজে সে-ই জলকাদার মধ্যেই গা এলিয়ে দেয়। ডাক্তার আনতেই হয়। সে-ও আবার পেশাদার ডাক্তার ! অভয় দিয়ে বলে, ক-মাস পারফেক্ট বেস্ট দিতে হবে। আমি একটা ভিটামিন টনিক লিখে দিচ্ছি, সেটা খাবেন। রোজ অন্তত আধাসের দুধ চাই। তাব বেশি হজম হবে না। তাই বিলাতি কোনো পার্সিয়ালি ডাইজেস্টেড মিল্কফুড— পুলক বলে, বাবা দুটাে টাকা দিয়ে ওকে যেতে বলে। মোহিনীর মাথায় ধার করা আইসবাগটা চেপে ধরে রেখে শুভ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বায়বাবুদের বাড়ির সামনে মোটরটা দাঁড়িয়ে আছে, ভিতরের সিটে বসে সিগারেট টানছে ড্রাইভার করালী। সিগারেট টানতে টানতে দু-একবার উৎসুক চোখ তুলে জানলার দিকে তাকাচ্ছে। ঘরের মধ্যে তাকে ভালো দেখতে পাচ্ছে না, আলো বড়ো কম ঢোকে। ঘরে, বাতাসের মতোই। জানালায় গিয়ে যদি সে দাঁড়ায়, করালীব উৎসুক চোখ ক্ষুধাতুর হয়ে উঠবে। শুধু চোখ। এমনিতে মুখে তার সর্বদাই একটা নিশ্চিন্ত নির্লিপ্ত ভাব। রায়বাবুদের বাড়ির মেযেদের কাছে শুভ শুনেছে করালীর কেউ নেই, যা রোজগাব করে সব নিজের জন্য খবচ হয়। আমাদের মতো গন্ধতেল সাবান মাখে, জানিস ? প্রথম ভাবতাম চুরি করে বুঝি। তারপর দেখা গেল, না, বাবু নিজের পয়সাতেই কেনে। ঘরভাড়া লাগে না, খাওয়াখরচ লাগে না.. সিগারেট ফেলে দিয়ে করালী চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। বেলা দশটা বাজে, দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে রায়বাবু এসে গাড়িতে উঠবে,-কিন্তু শুভ জানে, তারই মধ্যে করালী একটু ঘুমিয়ে নিতে পারবে। সে লক্ষ করেছে। ফাক পেলে যখন ইচ্ছা করালী ঘুমিয়ে নি” আিদ পারে। ঠিক তাই। কবালী শুয়ে পড়ার পাঁচ মিনিট পরে রাযবাবু বেরিয়ে আসে, কবালীর ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তুলতে হয়। নিজের সিটে বসে গাড়ির স্টার্ট দিয়ে আরেকবার সে উৎসুক চোখে জানালার দিকে তাকায়। শুভ ভাবে, যদি সম্ভব হত সঙ্গত হত তার সঙ্গে করালীর কথা বলা, তাকে তার মনের কামনা জানানো ! যদি সম্ভব হত, সওগাত হত করালীকে তার জানানো যে তার মনের ইচ্ছায় তারও সায় আছে। অনায়াসে করালী কোনো আত্মীয়কে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাতে পারত। তার বাবার কাছে, তারপর শূভ হােক অশুভ হােক কোনো একলগ্নে বাবার ঘাড় থেকে তার দায় নামত আর তাদের দুজনেরই সাধ আর সমস্যা মিটে যেত। একার আয় এক ভোগ করার বদলে তার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে কত খুশি আর কৃতাৰ্থ হত করালী । রায়বাবুদের পেট-মোেটা বিড়ালটা অনেকক্ষণ থেকে ঘরের আনাচে-কানাচে শুকে বেড়াচ্ছিল। এ বাড়িতে আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায় কদাচিৎ, দুধ রাখা হয় নামমাত্র, কে জানে বড়োলোকের বাড়ির