পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র নবম খণ্ড.pdf/৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ክrዪኃ মানিক রচনাসমগ্ৰ কী বিরাট ছন্দে কী বকম আশ্চর্য মসৃণ গতিতে শহরের এই একটি রাজপথে জীবনের স্রোত বয়ে চলছিল, কী বিচিত্ৰভাবে তাতে মেশানো ছিল নানা বিভেদ আর সামঞ্জস্য, ব্যাহত হয়ে থেমে যেতে সেটা যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আগে ছিল নানা আওয়াজের মেশােল দেওয়া একটানা গুঞ্জনধ্বনি, এখন তার চেয়ে জোরালো হয়ে ওঠে শুধু মুখর মানুষের মিলিত কলািবব। কত অল্প সময়ের মধ্যেই যে আবার ঠিক আগেকার অবস্থায় ফিরে যায় রাজপথটা! দুর্ঘটনা গুরুতর নয়। একজনও মরেনি, হাসপাতালে পরে কারও মরবার সম্ভাবনাও নেই। কয়েকজন আহত হয়েছে আর কমবেশি জখম হয়েছে খানচারেক গাড়ি । বেশি চোট লেগেছে সেলুন গাড়িটাবা ড্রাইভার আর যে মেয়েটি দুঘর্টনা ঘটিয়েছে তার-তবে তাদের আঘাতও তেমন মারাত্মক কিছু নয়। সেলুন গাড়িটার পিছনের সিটের ভদ্রলোকের মাথার পিছন দিকটা দেখতে দেখতে ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে, একখানা ফ্ল'ত গেছে মচকে। অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়ার আগেই পুলিশ ভিড়কে একপাশে ঠেলে দিয়ে রাস্তার ওপাশ দিয়ে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা চালু করে দেয়। অ্যাম্বুলেন্স এসে আহত মানুষ ক-জনকে নিয়ে যায় হাসপাতালে। বেশি জখম সেলুন গাড়িটার সামনের দিকটা শিকলে বেঁধে শূন্যে বুলিয়ে পিছনের দু চাকায় গড়িয়ে টেনে সরিয়ে যাওয়া হয়। তারপরেই দেখা যায় পথেও যেমন চলেছিল, তেমনই চলছে গাড়ি ও মানুষের দুমুখী পাবা। দাঁড়িয়ে থাকে কেবল সেলুনটার উপরে হ্রমাড়ি খেয়ে পড়েছিল যে লম্বাটে বড়ো গাড়িটা। এই গাড়িটা চালাচ্ছিল। আমাদের কেশব। কেশব ফুটপাতে নেমে গিয়েছিল আর গাড়িতে ওঠেনি। তার নাকি মাথা ঘুরছে। ললনা নিজেই গাড়িটা ধারে সরিয়ে এনে রেখেছে। তারপর কেটে গেছে। কয়েক মিনিট। কৌশল ফুটপাতে দাঁডিয়ে সিগারেট টানে আর ঘনঘন টোক গিলবার চেষ্টা করে। ললনা বলে, আপনার কী হল কেশববাবু ? দাঁড়িয়ে রইলেন যে ? কেশব বলে, আমার এখনও মাথা ঘুরছে। চালাতে পারব না। গীতা বলে, বাঃ বেশ ।। ওদিকে স্কুলে যে দেরি হয়ে যাবে আমার ? মাইনে করা ড্রাইভারেরও যে একটা মাথা আছে এবং বিশেষ অবস্থায় সে মাথাটা ঘুরতেও পারে, এটা ললনা স্বীকার করে নেয়। বলে, গাড়িতে এসে বসুন, আমিই চালাচ্ছি। মন্দ্ৰা তার হাত চেপে ধরে বলে, না ভাই ! কােজ নেই ! আরও কয়েক মিনিট সময় তারা কেশবকে দেয়। ড্রাইভারেরও মাথা ঘোরা গা কেমন করার অধিকার আছে বলেই শুধু নয়। কেশবের কাছে তারা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতাবোধ করছিল। কেশব তাদের আশ্চর্য রকম বঁচিয়ে দিয়েছে। গাড়িটা আরও বেশি রকম জখম হওয়া এবং তাদের বেশি আঘাত লগা উচিত ছিল, বিশেষ করে কেশবের। কেশবের মতো পাকা ড্রাইভার না হলে এত অল্পের উপর দিয়ে রেহাই পাওয়ার আশা সত্যই কম ছিল। কে জানে কীভাবে মাথা ঠান্ডা রেখেছিল কেশব ! এতক্ষণ এই কথাই তারা বলাবলি করছিল। নিজেদের মধ্যে। সামনের গাড়িটার সঙ্গে ধাক্কা লাগবেই জেনে সেটা এড়াবার চেষ্টায় সে দিশেহারা হয়ে বিপদ ঘটায়নি। পাশ কাটাবার চেষ্টা করলেই সেলুনটার উপরে গিয়ে পড়তে হত কোনাকুনি ভাবে। ফলটা হত ঢের বেশি খারাপ। তাই, পাশ কাটাবাব বদলে আরও সোজাসুজি সেলুন গাড়ির উপরে গিয়ে পড়বার জন্যই সে উলটো দিকে চাকা একটু ঘুরিয়ে দিয়েছে। এত সব ভাবলেন। কখন ?