আজ কাল পরশুর গল্প
মানসুকিয়ার আকাশ বেয়ে সূর্য উঠেছে মাঝামাঝি। নিজের রাঁধা ভাত আর শোল মাছের ঝাল খেতে বসেছে রামপদ ভাঙা ঘরের দাওয়ায়। চালার খড় পুরোনো পচাটে আর দেয়াল শুধু মাটির। চালা আর দেয়াল তাই টিকে আছে, ছ মাসের সুযোগেও কেউ হাত দেয়নি। আর সব গেছে, বেড়া খুঁটি মাচা তক্তা—মাটির হাঁড়ি-কলসিগুলি পর্যন্ত। খুঁটির অভাবে দাওয়ার চালাটা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কাত হয়ে। চালাটা কেশব আর তোলেনি। কার জন্য তুলবো? দাওয়ার দুপাশ দিয়ে মাথা নিচু করে ভেতরে আসা-যাওয়া চলে। অন্ধকার হয়েছে, হোক।
হুমড়ি খেয়ে কাত-হয়ে-পড়া চালার নীচে আঁধার দাওয়ায় নিজের রাঁধা শোলের ঝাল দিয়ে ভাত খেতে বসেছে রামপদ, ওদিকে খালের ঘাটে নৌকো থেকে নেমেছে তিনটি মেয়েছেলে আর একটি ছেলে।
এদের মধ্যে একজন রামপদর বউ মুক্তা। তার মাথায় রীতিমতো কপাল-ঢাকা ঘোমটা। সুরমার ঘোমটা সিঁথির সিঁদুরের রেখাটুকুও ঢাকেনি ভালো করে। এতে আর শাড়ি-পরার ভঙ্গিতে আর চলন-ফিরন-বলনের তফাতে টের পাওয়া যায় মুক্তা চাষাভুসো গেরস্থঘরের বউ, অন্য দুজন শহুরে ভদ্রঘরের মেয়ে বউ, যারা বাইরে বেরোয়, কাজ করে, অকাজ কি সুকাজ তা নিয়ে দেশজুড়ে মতভেদ। নইলে, শাড়িখানা বুঝি দামিই হবে আর মিহিই হবে মুক্তার, সাধনা আর সুরমার কাপড়ের চেয়ে। এর চেয়ে কম দামি ময়লা শাড়ি মুক্তার নেই। নইলে তাই পরে সে গাঁয়ে ফিরত।
তার বুক কাঁপছে, গা কাঁপছে, মুখ শুকিয়ে গেছে। মোটা চট মুড়ি দিয়ে বস্তা হয়ে আসতে পারলে বাঁচত, মানুষ যাতে চিনতে না পারে।
চিনতে পারা হয়তো কিছু কঠিন হত। কিন্তু মানসুকিয়ার কে না জানে মুক্তা আজ গাঁয়ে ফিরছে। বাবুরা আর মা ঠাকরুনরা রামপদর বউকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে এনে দিচ্ছে রামপদর ঘরে।
চারটি বাঁশের খুঁটির ওপরে হোগলার একটু ছাউনি—গগনের পানবিড়ির দোকান। পিছনের বড়ো গাছটার ডালপালার ছায়া এখন চওড়া করেছে হােগলার ছায়া। গাছের গুঁড়িটা প্রায় নালার মধ্যে ও পাশের ধার ঘেষে, নইলে গুঁড়ি ঘেঁষে বসতে পারলে হােগলার ছাউনিটুকুও গগনের তুলতে হত না।
কজন ঝিমুচ্ছিল বাঁচবার চেষ্টার কষ্টে, খানিকটা তারা সজীব হয়ে ওঠে। বুড়ো সুদাসের চোয়ালের হাড় প্রকাণ্ড, এমনভাবে ঠেলে বেরিয়েছে যে পাঁজরের হাড় না গুণে ওখানে নজর আটকে যায়।
রামের বউটা তবে এল?
তাই তো দেখি। নিকুঞ্জ বলে, তার আধপোড়া বিড়িটা এই বিশেষ উপলক্ষে ধরিয়ে ফেলবে কি না ভাবতে ভাবতে। এক পয়সার চারটি বিড়ি কিনেছিল কাল। আধখানা আছে।
ঘনশ্যামের টিনের চালার আড়ত থেকে গোকুল চারজনের ঠিক সামনে দিয়ে রাস্তা পেরোবার ছলে ঘনিষ্ঠ দর্শনের পুলক লাভ করে এদের সঙ্গে এসে দাঁড়ায়।
গদার বউ মারা গেছে ও বছর। ওরা খানিকটা গাঁয়ের দিকে এগিয়ে গেলে সে মুখ বাঁকিয়ে বলে, রাম নেবে ওকে?
না নেবে তো না নেবে। ওর বয়ে গেল। জোয়ান গোকুল বলে, ঘনশ্যামের আড়তে কাজ করে মোটামুটি পেট ভরে খেতে পাওয়ার তেজে।
সুদাস কেমন হতাশার সুরে বলে, উচিত তো না ঘরে নেয়া।