পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শহরবাসের ইতিকথা S ዒ মনোমোহনের পূর্বপুরুষ কবে এ গ্রামে আসিয়াছিলেন, বুড়া পীতাম্বর ঘটক সে খবর রাখে। খবরটা সে সকলকে বলিয়া বেড়াইতে লাগিল। আগেও গল্পটা সকলে অনেকবার তার কাছে শুনিয়াছে। একদিন দুটি যুবক এক সঙ্গে এই গ্রামে আসিয়াছিল, তাদের একজন পীতাম্বরের ঠাকুবদার বাবা, একজন মনোমোহনের ঠাকুরদার ঠাকুরদা। আজকের কথা নয়, তারপর শতাব্দী পার হইয়া গিয়াছে। এ গ্রামের কি তখন এ রকম লক্ষ্মীছাড়া অবস্থা ছিল ? কত শ্ৰী ছিল গ্রামের, কত ঐশ্বৰ্য ছিল, আজ গ্রামের ভাঙা ঘরদুয়ার দেখিয়া কে তা কল্পনা করিতে পরিবে ? মস্ত বড়ো বাণিজ্যকেন্দ্ৰ ছিল এই গ্রাম (কাছাকাছি নদী নাই, আশেপাশে বিশেষ কোনো পণ্য উৎপন্ন হয় না, কোনোদিন হইত কিনা সন্দেহ। তবু কি করিয়া গ্রামটা মস্ত বড়ো বাণিজ্যকেন্দ্ৰ হইয়া উঠিয়াছিল। সে কথা অবশ্য পীতাম্বরকে কেহ ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দিতে বলে না)। রাজা এই গ্রামে বাস করতেন (রাজবাড়ির একটি ইট-পাথরের চিহ্নও কোথাও খুজিয়া পাওয়া যায় না)। ধরিতে গেলে এ গ্রাম তখন নগর ছিল বলা যায়। পূর্বপুরুষ দুজন মলিন বেশে একদিন অবস্থার উন্নতির জন্য এখানে আসিয়াছিলেন। পীতাম্বরের পূর্বপুরুষটি ছিলেন বুদ্ধিমান, অল্পদিনেই তঁর অবস্থা ফিরিয়া গেল। মনোমোহনের পূর্বপুরুষটি বিশেষ সুবিধা করিতে পারিলেন না। পীতাম্বরের পূর্বপুরুষটির কল্যাণে কোনোরকমে তার দিন কাটিয়া যাইত । তারপর পীতাম্বরের ধর্মভাবু পূৰ্বপুরুষটি একদিন তীর্থভ্ৰমণে বাহির হইলেন, সমস্ত ভার দিয়া গেলেন বন্ধুকে, সরল্যুদয় বন্ধু চিরদিন যেমন তার বিশ্বাসী বন্ধুকে দিয়া যায়। তখনকার দিনে তো তীর্থভ্ৰমণ দুদিনের শখের ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায় নাই, তীর্থ সারিয়া আসিতে সময় লাগিতা অনেক, ফিরিয়া আসিবার সম্ভাবনা থাকিত কম। যে যাইত সে একরকম চিরবিদায় নিয়া যাইত । দু-তিন বছর পরে, ঠিক কত বছর পরে পীতাম্বরের মনে নাই, তীর্থ সারিয়া ফিরিয়া আসিয়া সে দেখিল, তার যথাসর্বস্ব বন্ধু গ্ৰাস করিয়া বসিয়া আছে, স্ত্রী-পুত্রের অন্ন জোটে না। পীতাম্বরের পূর্বপুরুষ বলিল, বন্ধু, এ কি ? মনোমোহনের পূর্বপুরুষ বলিল, কে তোমার বন্ধু ? তাই পীতাম্বরের আজ এই অবস্থা। তবে ভগবান আছেন, বন্ধুকে ঠকাইয়া মনোমোহনের পূৰ্বপুরুষ যা পাইয়াছিল, আজ তার সিকির সিকিও নাই। মনোমোহনের বাপিও কি সেদিন অপঘাতে মরে নাই, শহরের রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়িয়া মরে নাই ? পাপের পুরস্কার হাতে হাতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্মের জয় তো ঘটিবেই। পাপের শাস্তি যাইবে কোথায় ? এই যে কলকাতা যাচ্ছে মনোমোহন, ওকে নেওয়াচ্ছে কে ? তোমাদের বলে রাখছি শোনো, সর্বস্ব খুইয়ে পথের ভিখিরি হয়ে ও যদি না ফিরে আসে দুদিন পরে, ভগবান মিথ্যা, ধর্ম মিথ্যা। ছেলেমেয়ে যে হয়নি ওর, সে কার বিধান ? প্ৰায়শ্চিত্ত ভগবান আর টানবেন না ঠিক করেছেন, ক-পুরুষ ধরে পাপের ধন ক্ষয় করিয়েছেন, ওর বাপিটাকে অপঘাতে মেরেছেন, ওকে এবার সর্বস্বাস্ত করে প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ করাবেন, বংশটাও লোপ করে দেবেন। পীতাম্বরের গায়ের চামড়া ধবধবে সাদা, প্রথম বয়সে তামাটে ছিল। মাথার চুল, ভুরু, গোপ দাড়ি আর গায়ের লোমগুলি পর্যন্ত সাদা হইয়া গিয়াছে। কথাগুলি বলিবার সময় আনমনে পইতাটি সে আঙুলে জড়াইতেছিল, তার কথাগুলি তাই-পইতা হাতে করিয়া অভিশাপ দেওয়ার মতো 0शमांश्ल। মানিক ৫ম-২