মানদা বলে ভাঙো—মাথা ভাঙব তোমার আমি।
সন্ধ্যার পর মানদা ঝাঁপ খোলে। সন্ধ্যার পর সোয়ামির কাছে মেয়েমানুষের লজ্জা কী?
ভূতির ছেলে কানুর বয়স বছর বারো। ভূতির স্বামী গদাধর কাজ আর কাপড়ের খোঁজে বেরিয়েছে আজ এগারো দিন। খিদেয় কাতর হয়ে কানু ভূতির কয়েদখানার বাইরে থেকে কেঁদে বলে, মা, ওমা! খিদে পায় যে?
ভূতি বলে ভেতর থেকে, শিকোয় হাঁড়িতে পান্তো আছে, খে-গে যা নিয়ে।
পাড়তে পারি না যে। তুই দে।
ভূতি দিশেহারা হয়ে ভাবে, যাবো? ছেলে মাকে ন্যাংটো দেখলে কী আসে যায়? মা কালীও তো ন্যাংটো। ওমা কালী, তুইই বল মা, যাবো? বল মা, মোর হিদয়ে থেকে একটা কিছু বল।
কিন্তু সেদিন হঠাৎ তাকে উলঙ্গ দেখে কানু যেমন হি হি করে হেসেছিল, আজও যদি তেমনি করে হাসে? চোখ ফেটে জল আসতে চায় ভূতির, জল পড়ে না, জল শুকিয়ে গেছে চোখের। চোখ শুকনো, জ্বালা করে আজকাল কাঁদতে চাইলে।
হঠাৎ ছেঁড়া মাদুরটা চোখে পড়ে।
দাঁড়া একটু।
মাদুরটা সে নিজের গায়ে জড়ায়।
একহাতে শক্ত করে ধরে থাকে গায়ে জড়ানো মাদুরটা, আর এক হাতে দুয়ার খুলে রসুই ঘরে গিয়ে শিকে থেকে নামাতে যায় পান্তার হাঁড়িটা। পড়ে গিয়ে চুরমার হয়ে যায় হাঁড়িটা, পান্তা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। তখন মাদুরটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে ভূতি এঁটাে ভাত আর ভাত ভেজানো এঁটো জলের মধ্যেই ধপ করে বসে দু হাতে মুখ ঢেকে শুরু করে কান্না। আর এমনি আশ্চর্য কাণ্ড, এবার তার শুকনো চোখ থেকে জল বেরিয়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা মিশতে থাকে মেঝেয় ভাত ভেজানো জলে।
রাবেয়া বলে আনোয়ারকে, আজ শেষ। আজ যদি না কাপড় আনবে তো তোমায় আমায় খতম। পুকুরে ডুবব, খোদার কসম।
রাবেয়া কদিন থেকেই এ ভয় দেখাচ্ছে, তবু তার বিবর্ণ মুখ, রুক্ষ চুল আর উদভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে আনোয়ারের বুক কেঁপে যায়। চাষির ঘরের বউ দুর্ভিক্ষের দিনগুলি না খেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে কাটিয়ে দিয়েছে, কথা বলেনি, শাক পাতা কুড়িয়ে এনে খুদ কুঁড়োর সাশ্রয় করে তাকে বাঁচিয়ে লড়াই করেছে নিজে বাঁঁচবার জন্য। আজ কাপড়ের জন্য সে কামনা করছে মরণ। খেতে দিতে না পারার দোষ ও গ্রাহ্য করেনি, পরতে দিতে না পারার দোষ ও সইতে নারাজ, দিনভর ফুঁসে ফুঁসে গঞ্জনা দিচ্ছে। বিবিকে যে পরনের কাপড় দিতে পারে না সে কেমন মরদ, তার আবার সাদি করা কেন?
অনুনয় করে আনোয়ার বলে, আজিজ সাব খপর আনতে গেছেন। হাতিপুরের কাপড়ের ভাগ মিলবে আজকালের মধ্যে। একটা দিন সবুর কর আর।
সবুর! আর কত সবুর করব? কবরে যেয়ে সবুর করব এবার। শেমিজ না পরলে দু ফেরতা শাড়ি পরা রাবেয়ার অভ্যাস। এক ফেরতা কাপড় জড়িয়ে মানুষের সামনে সে বার হয়নি কোনো দিন। পায়খানার চটের পর্দাটি গায়ে জড়িয়ে নিজেকে তার বিবসনা মনে হচ্ছে। কাপড় যদি নেই, ঘোষবাবুর বাড়ির মেয়েরা এবেলা ওবেলা রঙিন শাড়ি বদলে নিয়ে পরে কী করে, আজিজ সায়েবের বাড়ির মেয়েরা চুমকি বসানো হালকা শাড়ির তলার মোটা আবরণ পায় কোথায়? সবাই পায়, পায় না শুধু তার স্বামী। আল্লা, এ কোন মরদের হাতে সে পড়েছিল।
রাত্রের ছায়ামূর্তি হয়ে রাবেয়া গিয়ে দেখে আমিনা জ্বরে শয্যাগত হয়ে পড়ে আছে, তার গায়ে দুটাে বস্তা চাপানো, চুনের বস্তা! বস্তার নীচেই আমিনার গায়ের চামড়া জ্বরে যেন পুড়ে যাচ্ছে।