পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/১৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৬
মানিক রচনাসমগ্র

 আমিনা বলে ফিসফিসিয়ে, গা জ্বলছে—পুড়ে যাচ্ছে! আজ ঠিক মরব। এ বস্তা মুড়ে কবর দেবে মোকে।


আবদুল আজিজ আর সুরেন ঘোষ হাতিপুরের একুশ শো চাষি ও কামার কুমার জেলে জোলা তাঁতি আর আড়াই শো ভদ্র স্ত্রীপুরুষের কাপড় জোগাবার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। মাস দেড়েক আগে উলঙ্গ হাতিপুর সোজাসুজি সদরে গিয়ে মহকুমা হাকিম গোবর্ধন চাকলাদারকে লজ্জিত করেছিল। এ ভাবে সিধে আক্রমণের উসকানি যুগিয়েছিল শরৎ হালদারের মেজো ছেলে বঙ্কু আর তার সতেরো জন সাঙ্গোপাঙ্গ। সতেরো মাইল দূরে স্বদেশসেবক তপনবাবুর কাপড়ের কল কয়লার অভাবে অচল হয়েও সাড়ে তিনশো তাঁত কী করে সচল আছে আর খালি গুদামে কেন অনেক শো গাঁট ধুতি শাড়ি জমে আছে, এ সব তথ্য আবিষ্কার করায় বঙ্কু আর তার সাতজন সাঙ্গোপাঙ্গ মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামার দায়ে হাজতে আছে সওয়া মাস। মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা তারা না করে থাকলে অবশ্য বিচারে খালাস পাবে, মিথ্যা হয়রানির জন্য ক্ষতিপূরণের পালটা নালিশও রুজু করতে পারবে আইন অনুসারে কিন্তু গুরুতর নালিশ যখন হয়েছে ওদের নামে, হাজতে ওদের থাকতে হবে। জামিন দেওয়ার অনেক বাধা। গভীর সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে জামিনের কথা।

 ঘোষ আর আজিজ সভা ডেকে ঘোষণা করেছে হাতিপুরের জন্য কাপড়ের ‘কোটা’ তারা যা আদায় করেছে, এবার কাপড়ের ভাবনা কারও ভাবতে হবে না। মনোহর শার প্রস্তাবে নিজেদের তারা হাতিপুরের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে। বিশ্বাস না করেও হাতিপুরের লোক ভেবেছে, দেখা যাক। আশা ছেড়ে দিয়েও হাতিপুরের নরনারী ভেবেছে, উপায় কী।

 দুজনে আজ সদরে গিয়েছিল, কবে হাতিপুরে এসে পৌঁছবে হাতিপুরের জন্য নির্দিষ্ট করা কাপড়ের ভাগ তারই খবর জানতে। গাঁয়ের লোক উন্মুখ হয়ে পথ চেয়ে আছে তাদের। ছায়ারা ঘরে ঘরে লুকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের মধ্যেও আগ্রহ ও উত্তেজনার শেষ নেই।

 বিকালে ছোটােখাটাে একটি জনতা জমে উঠল গ্রামের পুব প্রান্তে কাঁথি সড়কের বাস-থামা মোড়ে।

 ঘোষকে একা বাস থেকে নামতে দেখে জনতা একটু ঝিমিয়ে গেল। ভিড় দেখে ঘোষও গেল একটু ভড়কে।

 কী হল ঘোষমশায়, কাপড়ের কী হল?

 গোলমাল হয়েছে একটু।

 গোলমাল? কীসের গোলমাল?

 কলকাতা থেকে মাল আসেনি। ভাইসব, আমরা জীবনপাত করে—

 বঙ্কুর সাঙ্গোপাঙ্গদের একজন, সরকারদের অবিনাশ, সে সময়টা কলেরায় মরোমরো হয়ে থাকায় মারপিটের নালিশে হাজতে যেতে পারেনি। সে বজ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করে, শনিবার ক্ষেত্র সামন্তের চালান এসেছে সাত ওয়াগন। আমি দেখেছি, পুলিশ দাঁড়িয়ে গাঁট নামিয়ে গুনে গুনে চালান দিল।

 ও সদরের জন্যে। হাতিপুরের কোটা আসেনি।

 কবে আসবে?

 আসবে। আসবে। ছুটােছুটি করে মরছি দেখতে পাচ্ছ তো ভাই তোমাদের জন্যে?

হতাশ ম্রিয়মান জনতা গাঁয়ে ফিরে যাবার উপক্রম করছে, কাপড়ের গাঁট বোঝাই প্রকাণ্ড এক লরি রাস্তা কাঁপিয়ে এসে থামবার উপক্রম করে তাদের সামনে রাস্তার সেই মোড়ে। ড্রাইভারের পাশে বসে আছে আজিজ, তার পাশে সুরেন ঘোষের ভাই নরেন ঘোষ। সুরেন ঘোষ মরিয়া হয়ে পাগলের