পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/১৭৭

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আজ কাল পরশুর গল্প
১৭৭

মতো হাত নেড়ে ইশারা করে, আজিজ জনতার দিকে তাকিয়ে তার ইশারা দ্যাখে, ড্রাইভারকে কী যেন বলে, থামতে থামতে আবার গর্জন করে লরিটা জোরে এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অল্প দূরে পথের বাঁকের আড়ালে। লাল ধুলায় সৃষ্টি হয় মেঘারণ্য।

 জনতা ঘুরে দাঁড়ায়, একপা দুপা এগিয়ে এসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বাস তখনও ছাড়েনি। বাস থেকে নেমে এসেছে খাকি পোশাক পরা সুদেব, কোমরে চামড়ার চওড়া বেল্টটা তার কী চকচকে। লাল পাগড়ি আঁটা একজন চা আনতে যায় সুবলের দোকান থেকে—চা এবং একটা কীসের যেন চ্যাপটা শিশি আর সোডার বোতল। ঘোষের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে সুদেব ধরায়, টান মেরে ধোঁয়া ছাড়ে যেন ভেতরে কাঁচা কয়লায় আগুন ধরেছে মানুষের ভিড় দেখার উত্তেজিত রাগে।

 কীসের ভিড়?

 কাপড় চায়।

 হাঃ হাঃ। পরশু পচেটপুরে সার্চে গেছলাম নন্দ জানার বাড়ি। বাড়ির সামনে যেতেই হাত জোড় করে বলল, কী করে ভেতরে যাবেন হুজুর, মেয়েরা সব ন্যাংটাে। ওরা রসুই ঘরে যাক, সারা বাড়ি তল্লাশ করুন। আমায় যেন বোকা পেয়েছে। রসুই ঘরে ফেরারি ছোঁড়াটাকে সরিয়ে সারা বাড়ি সার্চ করাবে। আমি বললাম, বেশ। তারপর সোজা রসুই ঘরের দরজা ভেঙে একদম ভেতরে। আরে বাপরে বাপ, সে যেন লাখ শালিকের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেল মশায়। সব কটাই প্রায় বুড়ি, কিন্তু একটা যা ছিল মিঃ ঘোষ, কী বলব আপনাকে! পাতলা একটা উড়নি পরেছে, একদম জালের মতো, গায়ের রং দেখে তো আমি মিস্টার—


হাতিপুরের মানুষ হাতিপুরে ফিরে যায় ধীরে ধীরে। এদিকের আশা ফুরিয়ে যাওয়ায় হতাশার চেয়ে চিন্তা সকলের বেশি। এ ভাবে যখন হল না। তখন এবার কী করা যায়। কেউ যদি উপায় বাতলে দিত।

 জান নয় দিলাম রে আব্বাস, আনোয়ার বলে ভুরু কুঁচকে, কী জন্য জানটা দিব তা বল?

 ভোলা বলে, লুট করে তো আনতে পারি দু-এক জোড়া, কিন্তু তারপর?

 তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আকাশে ছোটাে চাঁদটি উঠেই আছে, দিন দিন একটু একটু বড়ো হবে। কদিন পরে জ্যোৎস্নার তেজ বাড়লে বন্দিনী ছায়াগুলির কী উপায় হবে কে জানে। চাঁদ ডুবলে তবে যদি বাড়ির বাইরে যাওয়া চলে, রোজ পিছিয়ে যেতে থাকবে শেষরাত্রির দিকে চাঁদ ডুববার সময়। বিলের ধারের বাঁধানো সড়কে নানারঙ শাড়ি পরা মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে বাবুরা কজন হাওয়া খাচ্ছেন। কাপড় তৈরির কলেই যে হাতিপুরের লোক কাজ করে ওই তার প্রমাণ। কিন্তু আরও কত লোকেও তো কাজ করে সতেরো মাইল দূরে কাপড় তৈরির কলে, তবে কেন ও অবস্থা তাদের? সবাই ভাববার চেষ্টা করে।

 হাতিপুরের ঘরে ঘরে খবর রটে যায়, কাপড় পাওয়া যাবে না।

 তবে যে ঢেঁঢরা দিয়ে গেল কাপড় পাওয়া যাবে? সকলে প্রশ্ন করল সন্ত্রস্ত হয়ে।

 রসুল মিয়ার দালানের সামনের রোয়াকে একঘণ্টা ধন্না দিয়ে পড়ে থেকে আনোয়ার বাড়ি গেল সন্ধ্যার পরে। শাড়ি না পাক, কথা সে আদায় করেছে। বাড়তি শাড়ি ঘরে ছিল। কিন্তু রসুল মিয়াও একটু ভয় পেয়ে গেছেন। অবস্থাটা একটু ভালো করে বুঝতে চান আগে। কদিন পরে তিনি একখানা শাড়ি অন্তত আনোয়ারকে দেবেন, আজ হবে না। তাই হােক, তাও মন্দের ভালো। রসুল মিয়ার কথার খেলাপ হবে না। আশা করা যায়। রাবেয়াকে এই কথাটা অন্তত বলা যাবে।

 রাবেয়া খানিক পরে ঘাট থেকে ফিরে আসে। অদ্ভুত রকম শান্ত মনে হয় আজ তাকে। আনোয়ার গোড়ায় তাকে দুঃসংবাদটা দেয়।

মানিক ৫ম-১২