শাড়ি পরে এল। প্রদীপে সামান্য তেল ছিল। কেশবের নারায়ণ সাক্ষী করে কন্যাদানের প্রক্রিয়ার সমস্তক্ষণ শৈলর বারবার মনে হতে লাগল, প্রদীপের তেলটুিকু মালিশ করলে বাপের পেটব্যথা হয়তো তাড়াতাড়ি কমে যেত, অতক্ষণ বাপ তার কষ্ট পেত না পেটের ব্যথায়।
নিবু নিবু প্রদীপের আলোয় কালাচাঁদ আর শৈলর হাত একত্র করে কেশব বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে। কালাচাঁদ দারুণ অস্বস্তি বোধ করতে করতে তাগিদ দেয়, শিগগির করুন। ঘরে যে ঠাকুর আছেন সে জানত না। ঠাকুর দেবতার সঙ্গে এ সব ইয়ার্কি ফাজলামি তার ভালো লাগে না। একটু ভয় করে। মনটা অভিভূত হয়ে পড়তে চায়। গৃহস্থের শান্ত পবিত্র অন্তপুরে জলচৌকিতে শুকনো ফুলপাতায় অধিষ্ঠিত দেবতা, সদব্রাহ্মণের মন্ত্রোচ্চারণ, নির্জন মাঠঘাট প্রান্তরের মফস্বলে পুঞ্জীভূত মধ্যরাত্রির নিজস্ব ভীতিকর রহস্য তাকে কাবু করে দিতে চায়। মনে মনে নিজেকে গাল দিতে দিতে সে ভাবে যে বুড়োর এ পাগলামিতে রাজি না হওয়াই তার উচিত ছিল।
প্রদীপটা নিবে যাওয়া মাত্র কালাচাঁদ হাত টেনে নিল। তার হাতে শৈলর হাত ঘামে ভিজে গিয়েছিল।
কালাচাঁদের গাও ঘোমে গিয়েছিল। রুমালে মুখ মুছে শক্ত করে শৈলর হাত ধরে টানতে টানতে সে বার হয়ে গেল। নিজেও বিদায় নিল না, শৈলকেও বিদায় নিতে দিল না। দোকানির কাছে ক্রেতা বা পণ্য কোনো পক্ষই বিদায় নেয় না বলে অবশ্য নয়; কালাচাঁদের ভালো লাগছিল না। শৈলও থ বনে গিয়েছিল।
শিউলি জবা গাছের মাঝ দিয়ে বাড়ির সামনে কাঁচা রাস্তায় পা দিতে দিতে এ ভাবটা শৈলর কেটে গেল। সেইখানে প্রথম হাত টেনে প্রথমবার সে বলল, আমি যাব না।
আরও কয়েকবার হাতটানা ও যাব না বলার পর জোরে কেঁদে উঠবার উপক্রম করায় তারই শাড়ির আঁচলটা তার মুখে গুঁজে দিয়ে কালাচাঁদ তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। তখন কয়েক মুহূর্তের জন্য হালকা রোগা শরীরে জোর এল অদ্ভুত রকমের। পরপর কয়েকবার রোমাঞ্চ আসার সঙ্গে হাত পা ছুঁড়ে সে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যেতে লাগল। মুখে গােঁজা আঁচল খসে পড়লেও দাঁতে দাঁত চেপে গোঁগোঁ আওয়াজ করতে লাগল। তারপর হঠাৎ শিথিল নিস্পন্দ হয়ে গেল।
সব শুনে কালাচাঁদের মন্দোদরী গোসা করে বলল, কী দরকার ছিল বাবা অত হাঙ্গামায়? আর কি মেয়ে নেই পিথিমিতে?
কেমন একটা ঝোঁক চেপে গেল।
ঝোঁক চেপে গেল! মাইরি? ওই একটা বোঁচানাকি কালো হাড়গিলে দেখে ঝোঁক চেপে গেল!
দুত্তোরি, সে ঝোঁক না কী?
কিন্তু মন্দোদরীর সন্দেহ গেল না। পুরুষের পছন্দকে সে অনেককাল নমস্কার করেছে, আগামাথাহীন উদ্ভট সে জিনিস। শৈলর জন্য কালাচাঁদের মাথাব্যথা, আদর যত্ন ও বিশেষ ব্যবস্থার বাড়াবাড়িতে সন্দেহটা দিন দিন ঘন হয়ে আসতে লাগল। সাদা থান ও শেমিজ পরা ভদ্রঘরের দেবীর মতো যে মন্দোদরী তার চোখে দেখা দিল কুটিল কালো চাউনি।
শৈলকে দেখতে ডাক্তার আসে। তার জন্য হালকা দামি ও পুষ্টিকর পথ্য আসে। অন্য মেয়েগুলিকে তার কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। কালাচাঁদ তার সঙ্গে অনেক সময় কাটায়।
একদিন ব্যাপারটা অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে গেল।
শৈলর চেহারাটা তখন অনেকটা ফিরেছে।
ওকে বাড়ি নিয়ে যাব ভাবছিলাম।
কেন?