ভূষণের মেয়ে রতন এসেছিল একখানা তাঁতের কাপড় পরে।
কী যা-তা বলছ বাবা। দাদা গেল তোমার জন্যে শোধ নিতে, তুমি বলছ তার মতলব ছিল। খেতে পাবার জন্যে কেউ জেলে যায়?
বলে সে হাঁটু বাঁকাবার যন্ত্রণায় মুখ বাঁকিয়ে গোপালের পায়ে ঢিপ করে প্রণাম করল।
গোপাল এসে মামাকে প্রণাম করেনি। যাবার সময় ভূষণের পায়ের পাতার আধ হাত তফাতে মাটি ছুঁয়ে সে প্রণাম সারল।
পথে নেমে জোতদার কানায়ের বাড়ির দিকে হাঁটকে হাঁটতে গোপাল ভাবে, পৃথিবীতে যা সব ঘটছে তা তার বোধগম্য হবে না। বিশ বছরের বেশি যে কাজ করে এসেছে সে দু মাস অসুখে ভুগে অশক্ত হয়ে পড়ায় কানাই তাকে ভাগিয়ে দিল! কেবল তাও তো নয়। দু এক যোজন দূরের হােক, কানায়ের সঙ্গে একটা সম্পর্কও যে আছে তার ভূষণমামার। যে সম্পর্কের জোরে তারও অধিকার আছে কানাইকে বড়োমামা বলার।
জোতদার কানায়ের বাড়ির কাছে এসে কান্নার আওয়াজ শুনে গোপাল থমকে দাঁড়িয়ে গেল। গাঁয়ে পা দেবার পর এই কান্নার শব্দে যেন তার নিজস্ব একটা অদ্ভুত স্তব্ধতার আবেষ্টনী ভেঙে পড়ল এতক্ষণে, বেলা যখন খতম হয়ে এসেছে। এখন তার খেয়াল হল, গাঁয়ের এতগুলি নারীপুরুষের বুকভরা শোক কান্নায় রূপ পায়নি, কান্না সে শোনেনি। গাঁয়ে এসে মৃত্যুপুরীর নীরবতাকে এতক্ষণ সে অনুভব করেছে। কিন্তু কতগুলি জীবন্ত কঙ্কাল চোখে পড়ায় সে অনুভূতিকে বুঝতে পারেনি। অথচ এ অনুভূতি তার কত চেনা। কতবার জনহীন শ্মশানে তার হৃদয় মন এ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
দাওয়ায় বসে কানাই আকাশ বাতাসকে শুনিয়ে অদৃষ্টকে শাপ দিচ্ছিল! গোপাল প্রণাম না করায় চটে গেলেও শ্রোতা পাওয়ায় সে খুশি হল। তার ছেলের আজ ফিট হয়েছে। দু বছরে তেরো হাজার টাকা উপায় করেছে এমন সোনার চাঁদ ছেলে। কোনো বিশেষ অপদেবতা বা অপদেবী নজর দিয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন এই নজর দেওয়া, এত ধম্মো কম্মো পূজা অৰ্চনা করার পর।
দু বচ্ছর চব্বিশ ঘণ্টা ভয়ে ভাবনায় দিন কাটাবার জন্যে হবে বা? শশী একটু ভয় কাতুরে বটে তো।
কীসের ভয় ভাবনা? সবিস্ময়ে কানাই শুধোয়।
এই ধরা টরা পড়ে জেলে যাবার ভয়। চোরাই কারবারে ভয় তো আছে।
কচু আছে। হাজার হাজার লোক করেছে না ও কারবার? তুই বাঁদর, জেল খাটিস। ওর জেলের ভয়টা কীসের? থেমে গিয়ে কানাই থুতনিটা ঘন ঘন এ পাশ ও পাশ নাড়ে আর লোমবিহ্বল বুকে বাঁ হাতের তালু ঘষে—অম্বলের জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছে বুকটা।
সুধাময়ী এসেছে আজ।
বটে নাকি? বেশ।
এয়েছে মানে আমি আনাইনি—এয়েছে। এনে ফেলে দিয়ে গেছে আমার বাড়ি। বেয়াই বেটা, জানিস গোপাল, বজ্জাতের ধাড়ি।
গোপাল খবরটা শুনেছিল। কানাইয়ের মেয়ে সুধার বিয়ে হয়েছিল গত বছর আশ্বিন মাসে। এ বছর কার্তিকের গোড়ায় সে প্রসব হতে এসেছে বাপের বাড়ি। জামাই এসে রেখে গেছে।
হুঁকো এসেছিল। কানাই হুঁকো টেনে কাশে আর বলে, পেটে তিনবার লাথি মেরেছে। নক্তে ভেসে যাচ্ছে পিথিমি। তাই ফেলে রেখে গেল হারামজাদার দল। এখন আমি ডাকব ডাকতার