১৯০
মানিক রচনাসমগ্র
কোবরেজ, টাকা খসাব মুঠো মুঠো—মরবে জানি, তবুও সব করা চাই। কেন বাবা? তিলে তিলে দগ্ধে মারা কেন বাপু? মরণ সংবাদ দিলেই হত একবারে!
ডাকতার এনেছেন কাকে!
মধুকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করিয়েছি। ওর গাছগাছড়া অব্যর্থ। ভীমের মাকেও আনেয়েছি। ও বড়ো ভাল দাই। একাজ করে করে চুল পেকে গেছে।
গোপাল শোনে আর ভাবে, কানায়ের বাড়ি কেন এসেছিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে হঠাৎ উঠে সে বিদায় নেয়।
কানায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে জীবনে প্রথম নিজের বিরুদ্ধে নালিশ করে গোপাল নিজেকে ধিক্কার দেয়, ভূষণের বাড়ির কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত। সুধার রক্তে পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে। ভীমের সত্তর বছরের বুড়ি মা, যে কানে কম শোনে, চোখে কম দ্যাখে, সে সুধাময়ীকে মারছে। এই রোমাঞ্চকর দৃশ্য মনে তার কেটে কেটে বসে গিয়েছে অথচ দুঃখ বেদনার বদলে সে অনুভব করছে সন্তোষ! যা হওয়া উচিত এ যেন তাই হয়েছে! নিয়ম রক্ষা—নীতির সম্মান বজায় থেকেছে। কানাই কষ্ট পাক, তাতে পরম তৃপ্তি বোধ হােক, ততখানি হিংসুটে ছোটােলোক হতে জেলখাটা গোপালের আপত্তি নেই। কিন্তু কানাইকে শাস্তি দেবার জন্য সুধাময়ীর রক্তে পৃথিবী ভাসিয়ে দেওয়ার মতো অমানুষ হওয়া কি তার উচিত?
গাঁয়ের অনেকের বাড়ি ঘুরেও কার কজন আপনজন না খেয়ে মরেছে শুনেও, ভূষণমামার সঙ্গে আলাপ করে সুধাময়ীর জন্য ব্যথা বোধের অক্ষমতায় গোপাল কাবু হয়ে রইল। ভূষণের বাড়ির কাছে যখন সে পৌঁছােল, সন্ধ্যা উতরে গেছে। চাঁদ বুঝি উঠবে মাঝরাতের কাছাকাছি, আকাশের কুয়াশায় তারাগুলি ম্লান, অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। ভূষণের মেয়ে রতন সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে এসে গোপালের হাত ধরল।
চাল এনেছ তো? আজ আগে চাল দেবে, তবে ছুঁতে দেব। মাইরি বলছি কানাইবাবু—হুস করে একটা শ্বাস টানার শব্দ হল।
কে? কে তুমি? প্রশ্ন না করেই রতন তাকে ছেড়ে দিয়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
তখন আবার গোপাল টের পেল পথ নির্জন। সন্ধ্যার খানিক পরেই এত বড়ো গাঁয়ের মৃত জনহীনতায় একা সে জীবন্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দায়িক হয়ে। সুধাময়ীর কথা সে ভুলে গেল। রতনকে সে বড়ো স্নেহ করত।