পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/১৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



মঙ্গলা

শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মঙ্গলা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ডোবা থেকে উঠে আসে। পুলিশ হঠাৎ গাঁয়ে হানা দিয়েছিল মাঝরাতে। সেই থেকে এই সকাল পর্যন্ত সে ডোবার জলকাদায় আগাছার মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে কাটিয়েছে।

 হাঙ্গামার পর থেকে এই নিয়ে পুলিশ সাতবার হানা দিল গাঁয়ে। আবার যদি হানা দেয় কিছুকাল পরে, শীত যখন আরও বেড়ে যাবে, এতক্ষণ ডোবায় এ ভাবে লুকিয়ে থাকতে হলে ডোবার মধ্যেই সে জমে কাঠ হয়ে যাবে নিশ্চয়, উঠে আর আসতে হবে না। অঘ্রাণের শেষেই হাত পা তার অসাড় হয়ে গেছে, পোষ মাঘের বাঘ মারা শীত সইবে কতক্ষণ!

 হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে দিশেহারা হয়ে ছুটে ডোবায় নামবার সময় বাঁ পায়ের তলাটা কীসে যেন কেটে গিয়েছিল অনেকটা, ভাঙা কাচে না শামুকগুলিতে কে জানে। কত রক্ত যে বেরিয়ে গেছে দেহ থেকে ঠিকানা নেই। আঁচল জড়িয়ে শক্ত করে বেঁধেও রক্ত বন্ধ করা যায়নি বহুক্ষণ, চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়েছে সে বেশ টের পেয়েছে। আঁচলটা কী লাল হয়েছে দ্যাখো।

 সকাল বেলার রোদের মৃদু। তেজে মঙ্গলার অসাড় অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ধীরে ধীরে সাড়া আসে, ঘনঘন কেঁপে কেঁপে সে শিউরে ওঠে। হঠাৎ সে কেঁদে ফেলে ফুঁপিয়ে। প্রায় জমে যাওয়া অনুভূতিগুলিও যেন তার সূর্যের তাপে এতক্ষণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

 তাড়াতাড়ি শীতের কাঁপুনি কমাতে কানাই এক ছিলিম তামাক সেজে নিয়েছিল। দুহাতে ছিলিমটা পাকিয়ে ধরে সাঁসাঁ করে কয়েকবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আধবোজা গলায় সে বলে, কাঁদিসনি মঙ্গলা। পরের বার ভাগবনি আর। ঘরে থাকব। যা করার করবে।

 পাছা টনটন করে ওঠে মঙ্গলার। পাছায় সে বেত খেয়েছিল দুমাস আগে, সে ব্যথা আজও থাকার কথা নয়। তবে উলঙ্গ করে বেত মারা হয়েছিল বলে বোধ হয় ঘটনার সঙ্গে শারীরিক বেদনাটাও তাজা কটকটে হয়ে আছে স্মৃতিতে।

 কানাইয়ের ছোটো ভাই বলাই ডোবায় না গিয়ে উঠেছিল বাড়ির দক্ষিণে তেঁতুল গাছটায়। ওদের মতো জলকাদায় ভিজে শীতে কষ্ট না পেলেও সমস্ত শরীরটা তার ব্যথায় টনটন করছে। কলকেটা নিয়ে দাদার দিকে পিছন ফিরে বসে টান দিয়ে সে বলে, মোদের আর কিছু করবে না মন করে। ফেরার ক জনার জন্যে তো হানা দিচ্ছে, মোদের মারধোর আর না করতে পারে।

 বলেছে তোমার কানে কানে, পিরিতের স্যাঙাত তুমি।

 মঙ্গলা গর্জে ওঠে। সেই সঙ্গে তারস্বরে উদ্ধার করতে আরম্ভ করে জগতে যেখানে যত পুলিশ আছে তাদের চোদ্দোপুরুষকে।

 বাড়ির সামনে পথ দিয়ে যেতে যেতে কথাগুলি শুনতে পায় অধর ঘোষাল। হনহনিয়ে বাড়ির মধ্যে এসে মুখে হাত চাপা দেওয়ার মতো ব্যস্ত বিহ্বল মানায় তাকে থামিয়ে দেয়।

 থাম ছুঁড়ি, থাম। কে গিয়ে খবর দেবে, মরবি যে তখন?

 ঠিক। সবার হাঁড়ির খবর যাচ্ছে, অবাক কাণ্ড।

 ভূষণ শালা একজন, ও বাড়ির ভূষণ মাইতি।

 অধর ব্যাকুলভাবে ধমকে বলে, থাক না বাবা, থাক না। অত দিয়ে কাজ কি তোদের, চুপ মেরে থাক না?