পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/২৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

86: o মানিক রচনাসমগ্ৰ মথুর ডাক্তারের অভয়বাণী শুনে রঘু হঠাৎ কেমন ভয় পেয়ে গেল। ডাক্তারের পরীক্ষার সময় সেও কাছে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দুৰ্গাকে দেখেছে। তারও জানা ছিল দুৰ্গা এবার মরতে পারে, আজকেই দুর্গ তার নজরে পড়েছে কয়েকবার, অথচ সে সত্যসত্যই জানত না এমন বিশ্ৰী হয়ে গেছে তার ছোটাে বউটার চেহারা। গলা পর্যন্ত কঁাথা ঢাকা দিয়ে চিত হয়ে দুর্গ বিছানার সঙ্গে মিশে শুয়ে আছে, পেটটা শুধু তার উচু। শীর্ণ বিবৰ্ণ মুখের দুটি কোটরে জুরের ধকে জুলজুল করছে কালো দুটি চোখ। বাড়িতে ডাক্তার এলে এমনি মনটা দমে যায় মানুষের, ভুলে যাওয়া রোগ শোক অজানা বিষাদ হয়ে ঘনিয়ে আসে, সমবেদনায়। থমথম করে অনুভূতির জগৎ । দুর্গার দিকে চেয়ে থেকে তার যে কঠিন অসুখ হয়েছে অনুভব করে রঘুর ভেতরে অস্থির অস্থির করছিল। মথুর ডাক্তারের মুখে রোগের আশাপ্ৰদ আলোচনা শূনে সেটা ভয়ে পরিণত হয়ে গেল। বাঁচবে তো ডাক্তারবাবু ? বাঁচবে না ? কেন, ওর হয়েছে কী ! ছেলেপিলে হবে বলে একটু যা ভাবনার কথা, নইলে অসুখ তো সেরে যাবে দু দাগ ওষুধে । ওষুধ লিখে দেবার কাগজ বাড়িতে না পাওয়ায় মথুর চটে গেল। রোগের এই মরশুমের সময় চারিদিকে তার অসংখ্য রোগী, তার কি বসে থেকে নষ্ট করাবর মতো সময় আছে ! দাও বাপু, ওই ঠোঙাটা এগিয়ে দাও। ঠোঙার কাগজেই মথুর ওষুধ লিখে দিল। তার নিজের দোকান থেকেই ওষুধ আসবে। এমনভাবে সে প্রেসক্রিপশনে লেখে যে সে ছাড়া আর কারও পড়বার ক্ষমতা থাকে না। অনেকদিন কম্পাউন্ডারি করে মথুর ছোটোখাটো একটি ওষুধের দোকান খুলে সস্তায় ডাক্তারি। আরম্ভ করেছিল, চাষি মজুরদের মধ্যে তার খুব পিশার। ফি সে যে শুধু কম নেয় তা নয়, তার সঙ্গে দরদস্তুর করে আরও দু-চার আনা কমানো যায়, পয়সার বদলে ফলমূল, ধান, চাল, দুধ, দই দিয়েও তার পাওনা মেটানো চলে। চাষিরা তাই অত্যন্ত পছন্দ করে তাকে। যাবার সময় মথুর বলে যায়, শুধু বার্লি আর ওই ফুডটা খাওয়াবে বাপু ! যেমন বললাম তেমনই করে খাওয়াবে। ফুডটা কোথায় পাবে জানি না আমার কাছে নেই। পাও যদি তো দাম দিতে কান্না আসবে, তাও বলে যাচ্ছি। আগে থেকে। কিন্তু ওটা চাই। গায়ে জোর নেই কো একদম, পেট কিছু সইবে না, ওটা এনে খাওয়াতে হবে। দুধ টুধ ভাতটাত আর দিয়ে না। কিন্তু, খবরদার ! রঘু নিজের মনে খানিক চিস্তা করে বলে, হঁয়া, শালার ডাক্তার ভালো। ঠিক ধরেছে। ছোটো বউ, শূনছ ? যা তা খেয়োনি। চি চি গলায় দুৰ্গা বলে, খেতে দেয় নাকি মোকে ? খিদেয় মরে যাই না ? রঘু বিরজার মুখের দিকে তাকায়। বিরাজা মাথা নেড়ে বলে, চোখের খিদে। কাঞ্চার হয়েছিল মনে নেই ? যেমন খায় ঠিক তেমনই সব বেরোয় আর সারাখন খাইখাই করে মরে ? কতো খাওয়ানু তবু পাকাটি হয়ে গেল না। আমন ছেল্যা মোর, মরে গেল না ! চোখের খিদে মরণ খিদে। বার্লি তোলা রইতে পারে একটুকু, ফুটিয়ে দিচ্ছি, খাওয়াও না কেনে। বিরজা যেন রাগ করেই বার্লি ফুটিয়ে আনতে যায়। কিন্তু রঘু জানে এটা তার রাগ নয়। মৃত সস্তানের কথা মনে পড়লেই বিরজার সব কথায় কলহের সুর আসে, দুপ দাপ পা ফেলে সে হাঁটে। দুৰ্গার কাছে গিয়ে রঘু তার কপালে হাত দিয়ে জুর অনুভব করে, হাতের তালু এবং উলটাে পিঠ দুদিক দিয়েই জ্বরটা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করে। মথুর ডাক্তার থার্মেমিটার দিয়ে বলে গেছে। জুর কত, কিন্তু রঘুর কাছে স্পর্শ না করে তাপ টের পাওয়ার কোনো অর্থ নেই। একশো তিন বেশি জ্বর তা সে জানে, কেমন ধারা বেশি সেটা তো জানতে হবে গায়ে হাত দিয়ে।