পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/২৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানিক রচনাসমগ্ৰ 8ܓ মেয়েলোক। কিন্তু পিরিত জানা সোহাগ-বেতর পুরুষচাটা এ মাগির খপ্পরে পড়লে ছেলে তো তার বিগড়ে যাবে ! দুধ নিতে এসে চিন্তামণি বেড়াতে গেছে। রঘুর বাড়ি, কাকার নামে নালিশ্ব করার বিগড়ানো মন নিয়ে নিজের বাড়ি না। ঢুকে গীেরও এল রঘুর সঙ্গে পরামর্শ করতে। বাবুর ছেলেকে চিন্তামণি হাওয়া খাইয়ে বেড়াচ্ছে। জল, ধরা গলায় সে বিরজাকে তার দুঃখের কাহিনি শোনাচ্ছে। রঘু বসেছে একটু তফাতে, তাকেও শোনাচ্ছে। দুঃখের কাহিনি কোনো জাতের কোনো মেয়ে কোনোদিন বলে শেষ করে উঠতে পারেনি। গীের এসে পড়ায় চিন্তামণিকে থামতে হল, আঁচল দিয়ে চোেখ মুছতে হল। গীের তাকিয়ে থাকে। চিস্তামণির দরদ আছে তার জানা ছিল কিন্তু সে যে কঁদতে পারে। আজ এই মাত্ৰ যেন তার সে বিশ্বাস জন্মাল একেবারে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখে। কঁদেছি কেন গো ? কপালে আছে কঁদেছি । এ জবাবে রহস্যের মুখ ঝামটা আছে, সেটা বেমানান হওয়ায় গীের অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। কাল পর্যন্ত চিন্তামণি তাকে তার সমস্ত দুঃখের কথাই বলেছে। এর মধ্যে এমন কী ঘটল। তার কপালে যে বলতে গিয়ে তাকে কঁদতে হচ্ছে ? সব তো জানো, আর জিগগেস করছ কী ? তখন গীের বুঝতে পারে যে নতুন কিছু হয়নি, তাকে যে সব কাহিনি বলবার সময় সে শুধু সব কাহিনি বলার সময় সে আজ কেঁদেছে! নিশ্চিন্তু হয়ে গীের রঘুকে বলল। তোমার কাছে এলাম রঘুদা। একটা কাণ্ড করেছি। বটে ? রঘু বলল। এ ওমা, সি কি ! বলল চিন্তামণি। গীের তার নালিশ করার কথা বলে, মেয়েরা উৎসুক হয়ে কাছে সরে আসে। বাবুর ছেলের কান্না থামাতে একটু আদর করেই চিস্তামণি বিরক্ত হয়ে তাকে একটা চড় বসিয়ে দেয়। তাতে কান্না আরও বেড়ে গেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো উপায় না দেখে সে করে কি, কাপড়ের তলে খোকার মাথাটা ঢুকিয়ে স্তনের বেঁটা তার মুখে গুজে দেয়। বিরজা মুচকে একটু হাসে। রঘু যেন আনমনে শুনে যায়, না করে কোনো আওয়াজ, না দেখায় কোনোরকম ঔৎসুক্য। একটু কেমন ঝিমিয়ে গেছে। রঘু আজকাল, কেমন একটু নিরাসক্ত ভাব দেখা দিয়েছে তার মধ্যে। চলতি কিছুর গতি একটু কম হওয়ার মতো জীবস্ত থাকার হাজার হাজার রকমসকমগুলি আগের চেয়ে একটু শ্লথ হয়েছে-একটুখানি। দুর্গার শোক এখনও তার থাকা সম্ভব নয়, নেইও। শোক কারও চব্বিশ ঘণ্টা থাকে না। একটা মানুষ আছে আছে হঠাৎ একটু ডুকরে কঁাদল নয় বুক চাপড়ে হায় হায় করল নয় মুখে মেঘ নামিয়ে আনল—সেটা হল শোক। বরাবর সে এমনি হলে লোকে জানত যে লোকটাই এমনি। কিন্তু দুর্গার মারা যাবার পর সে বদলেছে বলে সময় সময় মানুষ সেটা টের পাচ্ছে। সমস্ত খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করে গৌর বলে যায়, এদিকে দিনের আলো স্নান হয়ে আসে আকাশে। সন্ধ্যার আগে বাবুর ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে না নিয়ে গেলে মুশকিল হবে চিস্তামণির, কিন্তু শেষ পর্যন্ত না শূনে সে উঠেই বা যায় কী করে ? ঈশখুশ করতে করতে সে একসময় উঠে দাঁড়ায়। শোনো, তোমায় বলতে ভুলে গিাইছি। বাবু তোমায় ডেকেছেন ।