পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/২৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিস্থিতি 良部á এমনই যখন চলিতেছিল, লাবণ্যকে বাপের বাড়ি পাঠানোর কথাটা রমেশ তাকে বলিতে গোল এবং সংক্ষিপ্ত অর্থহীন কলহের পর ধনেশ তার গালে বসাইয়া দিল চড়। কদিন পরে মাসকাবারে বেতন ও ছুটি পাইলে রমেশ নিশ্চয় লাবণ্যকে বাপের বাড়ি রাখিয়া আসিবে। নিজে বোর্ডিং অথবা মেসে চলিয়া যাইবে। মাঝখানের এ কটা দিন এমনইভাবে মুখের সামনে সিগারেট টানিয়া, নির্বিকার উদ্ধত ভঙ্গিতে পাশ কাটাইয়া চলিয়া, একা লাবণ্যকে সঙ্গে করিয়া বেড়াইতে বাহির হইয়া, তার সবচেয়ে গভীর হতাশা ও বিষাদের মুহুর্তে পাশের ঘরে ঠুংরি সুরে গান ধরিয়া দাদাকে আঘাত দেওয়া ও অপমান করার কাজে লাগাইতেছে। সদরের চৌকাঠ পার হওয়ার সময় চোখে জল আসিয়া পড়িল। তিনদিনে রমেশের গায়ের জুলা কমে নাই। আজ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলিবার চেষ্টা করিবে ভাবিয়াছিল। পয়লা কি দোসরা তারিখে লাবণ্যকে বাপের বাড়ি রাখিয়া আসিতে বলিয়া কথা আরম্ভ করিবে, তারপর কিছুক্ষণ একথা সেকথা বলিবে। বিপদের কথা নয়, ভয়ের কথা নয়, সংসারের সাধারণ কথা। কিন্তু তাকে দেখিবামাত্র সাপের মতো কুর ভঙ্গিতে যে ফণা তুলিয়াছে, তার সঙ্গে যাচিয়া কীভাবে কথা বলা যায়। সিগারেট খাক, সে জন্য নয়। ত্রিশ বৎসরের উপযুক্ত ভাই, সামনে খাইলেও দোষ হয় না। তবু একটু আড়াল দিবার, একঘরে থাকিলেও অন্তত তার পিছন দিকে জানালায় সরিয়া গিয়া সিগারেট টানিবার যে প্রথা ছিল, যুগযুগাস্তের সংস্কারের চেয়ে সেটা কম বর্জনীয় নয়। রমেশ যে শত্ৰুতা করিতে চায় তার এত স্পষ্ট ও নিষ্ঠুর ইঙ্গিত। আর কীসে মিলিত ! একটি গািট ভাঙিলে শিকল ছিড়িয়া যায়, এই একটি নিয়ম ভাঙিয়া ভাই তার স্নেহমমতা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের বঁাধন ভাঙিয়া দিয়াছে। বাড়ির মধ্যে ছোটাে ছেলেমেয়ে দুটি প্ৰাণপণে চেচাইতেছে। একজনকে মারিয়া উপরে গিয়াছে উমা, আর একজনকে পিটাইতেছে। পাবুল। ব্যাপারটা বুঝিয়া ধনেশ মুখ খুলিতে না খুলিতে তড়বড় করিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিয়া কী জোরে ধাক্কা দিয়াই সে পাবুলকে হাঁটাইয়া দিল। বেহায়া নচ্ছার মারে ? তুমি মারলে আমায় ! তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলে, কিছু বললে না বাবা ? পাবুলের নাক ফুলিয়া উঠিয়াছে, সাদাটে সৰু গলায় তিন চারটা নীল শিরা ফাঁপিয়া স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে, বিস্ফারিত চােখে বিহুল দৃষ্টি।-থাকব না তোমাদের বাড়িতে আমি আর। নার্স হয়ে যাব-এক্ষুনি নার্স হয়ে যাব। আঁচল ধরিয়া হেঁচকা টানা দিয়া মেয়েকে থামাইয়া উমা বলিল, কোথা যাচ্ছিস ? আমি এক্ষুনি শীলাদির কাছে গিয়ে নাম লেখােব। ছেড়ে দাও বলছি আমাকে ! গা ধুইতে নীচে নামিয়াছে, গায়ে জামা নাই। ও সব যেন গ্রাহ্যও করে না, এমনিভাবে পারুল চেচাইতে থাকে। উমা আঁচল ছাড়িয়া না দিলে সে যেন বিনা কাপড়েই পথে বাহির হইয়া যাইবে, এমনই উন্মাদিনী মনে হয় তাকে। দেখিলে কল্পনাও করা যায় না, কয়েকমাস আগে এই পারুল ছিল ধীর, স্থির, শান্ত ও সংযত মেয়ে, চুপচাপ সংসারের কাজ করিত, মুখে ফুটিয়া থাকিত সলজ নম্ৰ হাসি। তোরা কি আমায় পাগল করে দিবি ! ধনেশ যেন আর্তনাদ করিয়া উঠিল। উপরের বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়া লাবণ্য নিঃশব্দে চাহিয়া দেখিতেছে। নীচের উঠানে যা ঘটিতেছে সে সব যেন অজানা অচেনা প্রতিবেশীর বাড়ির ব্যাপার, তার কিছু বলারও নাই করারও নাই। ভাসুর আসিয়া দাঁড়ানোর অনেক আগে হইতেই সে এইভাবে এইখানে দাঁড়াইয়া উদাসীনের মতো সব দেখিতেছিল। মাজা বাসনের তাড়া উমা পা দিয়া ছড়িয়া দিল-দিক। দু' বছরের শিশুকে বেদম মারিয়া উমা উপরে উঠিল,-উঠুক। খেলা ফেলিয়া পাঁচ বছরের মিনু উপর হইতে সাবান