পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/৩১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VDYo মানিক রচনাসমগ্ৰ সেই সঙ্গে এতদিন পরে একটা ভয় ঢোকে খাদুর মনে। এতকালের মাইনের টাকাগুলি জমা রেখেছে দত্তগিরির কাছে, হিসেবও জানে না সে কত টাকা হবে, দত্তগিন্নি যদি তাকে ফাকি দেয়, যদি একেবারে নাই দেয় টাকা ? বোকার মতো কাজ করেছে, খাদু ভাবে। মাসে মাসে মাইনে চুকিয়ে নিয়ে নিজের কাছে টিনের তেরঙ্গে রাখেনি বলে আপশোশ করে খাদু। হায় গো, টাকাগুলি যদি মারা যায় তার ! কী কিনবে ভাবতে ভাবতে সোনার একটা আংটি কিনে বসে খাদু বারো আনা দিয়ে। খাটি সোনা নয়। কিন্তু ঠিক যেন সোনা, কী সুন্দর যে মানিয়েছে তার বঁ হাতের সেজে আঙুলে। বিয়েতে একটা আসল সোনার আংটি পেয়েছিল খাদু, বছর না ঘুরতে সে আংটি কেড়ে নিয়েছিল বরটা তার, ফিরে দেবে বলেছিল বটে। কিন্তু আরও যে বছরখানেক বেঁচেছিল তার মধ্যে দেয়নি। ও মিছে কথা, বেঁচে থাকলেও দিত না, খাদু জানে। তারপর কতকাল আংটি পরার শখটা খাদু চেপে রেখেছিল, এতদিনে মিটাল। কিন্তু না গো, মিটেও যেন মিটাল না, প্ৰথম বয়সের সাধ কি আর মেটে মাঝ বয়সে, নিজে নিজের সাধ মেটালে, কেউ আদর করে কিনে না দিলে। বজাতেরা তাকায়, গায়ে গা ঘষে যায় ছলে কৌশলে, খানিক আগে থেকেই পিছু নিয়েছে। ওই বাবুসাজা লোকটা। ফিনফিনে পাঞ্জাবির নীচে গেঞ্জিটা যেমন স্পষ্ট, ওর মতলবও স্পষ্ট তেমনি। খাদু ওসব গায়ে মাখে না, রাগ করে না, বিচলিত হয় না। মেলাতে এ রকম হয়, কতকগুলি লোক এই করতেই আসে মেলায়, মেয়েলোকের গায়ে একটু গা ঠেকিয়ে মজা পেতে, পুরুষ হয়ে চোরের মতো এইটুকু নিয়ে বর্তে যায়, কী ঘেন্না মাগো। আসল বজাত ওই লোকটা যে পিছু নিয়েছে একলা মেয়েলোক দেখে, গুন্ডা না হলে কেউ কখনও দারোয়ান গাড়োয়ানের চেহারা নিয়ে বাবু সাজে। নিক পিছু, ঘুবুক সঙ্গে সঙ্গে। বোকা হাবা মেয়ে ভেবেছে খাদুকে, টের পাবে ভাব করতে এলে, এই ভিড়ের মাঝে খাদু যখন গলা ছেড়ে শুরু করবে। গাল দিয়ে ওর চোদোপুরুষ উদ্ধার করতে। পড়ন্ত রোদের মতো তেজ কমে কমে আসে। খাদূর আনন্দ ও উত্তেজনার, নিভে যেতে থাকে উন্মাদনা। একা আর কতক্ষণ ভালো লাগে মেলা, কথা কওয়ার কেউ একজন সাথে নেই। খিদে পায়। এতলোকের মাঝে খেতে লজ্জা করে খাদুর। ভাজা পাপড় কিনে আঁচলের তলে লুকিয়ে ফেলে বঁ হাতে, ডান হাতে এক এক টুকরো ভেঙে নিয়ে এমন ভাবে মুখে দিয়ে চিবোয় যে কেউ টেরও পাবে না পান।সুপারি মুখে দিয়ে চিবোচ্ছে না কিছু খাচ্ছে। এমন সময় কাণ্ড দ্যাখো কপালের, খাদু সোজাসুজি সামনে পড়ে যায় দত্তবাবুর। তাকিয়ে দেখতে দেখতে দত্তবাবু উদাসীনের মতো এগিয়ে যায় পাশ কাটিয়ে, আস্তে আস্তে থামে, ফিরে কাছে গিয়ে বলে, মেলা দেখতে এয়েছিস ? যেন মেলাতে মেলা দেখতে আসেনি খাদু, এসেছে ঘাস কাটতে। তিরিশের ওপরে বয়স হবে দত্তবাবুর, বিয়ের চার বছর পরে জন্মেছে খোকাটি, খোকার তিনবারের জন্মদিন বলে কি মাস আগে খাওয়াদাওয়া হল বাড়িতে। টুকটুকে ফরসা রঙের না-মোটা না-রোগা সুন্দর চেহারা দত্তবাবুর, মুখখানা ফ্যাকাশে, চুপিসানো। দেখে এমন মায়া হয় খাদুর। গিন্নিমা শুষে শুষে শেষ করে দিয়েছে। পেতে সব শুনেছে সব জেনেছে খাদু। বউ-বর খেলো দেলো শূতে গেল মিলল মিশল ঘুমাল, এই তো নিয়ম জানে খাদু, গিন্নিমা যেন মাগি মাকড়সার মতো তাতে খুশি নয়, রাত বারোটায় শ্রাস্তিতে ক্লাস্তিতে অবসাদে মরোমরো বরটাকে যে করে হােক জাগিয়ে তুলে খাবেই খাবে, বেশি যদি নেতিয়ে পড়ে তো বঁঝিয়ে বলবে, মেয়ে বন্ধু তো গাদা গাদা, কার সাথে কারবার করে এলে আজ যে বিয়ে করা বউকে এত অবহেলা ? আড়ি পেতে বাবুর কাতরতা দেখতে দেখতে যেন একশো বিছে কামড়েছে খাদুকে, চিৎকার করে বলতে সাধ গেছে, লাথি মেরে রাকুসিকে বার করে দিয়ে ঘুমো না, কেমন ধারা পুরুষ তুই!