পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/৩৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিস্থিতি \ථ6:G ক জন ঠিকমতো কাজ করছে। একটা তালা খুলবাের ক্ষমতাও তার নেই। তবু তার কথা শুনে মনে হয়, চারিদিকের ওতপাত মুনাফাখোরদের কবল থেকে সেই বুঝি এই খাদ্যগুলি প্ৰাণপণ চেষ্টায় বঁচিয়ে সাধারণ দুঃখী লোকের জন্য জমিয়ে রেখেছে। তবে, শশাঙ্ক কখনও শত্ৰুতা করে না। হাতের তালুতে ভাজকরা কিছু নিয়ে ওর হাতে হাত মেলালে খালি হাত ফিরে আসে, খাতির বাতিল করার বাহাদুরি ওর নেই। তার সরবরাহ আটহাজার মন আটা দেখে সেও মুখ বঁকিয়েছিল, কিন্তু সময়মতো জায়গামতো ঠিক কথাটি বলতে কসুর করেনি,-আটা মোটা হলে একটু ভেঁাতা গন্ধ ছাড়ে হুজুর, নতুন আটাতেও। লোকে এ আটা পেলে লুফে নেবে ! না বললেও অবশ্য ক্ষতি ছিল না কিছু। কেনা মাল যেমন হােক গুদামে তোলাই তখন কাজ। পরের কথা পরে { শশাঙ্ক নিজেও জানে না বিশেষ দরকার না থাকলেও নিবারণ বা মি. রায়ের পক্ষ টেনে সময় মতো ও সব সমর্থনের কথা কেন সে বলতে যায়। কতটুকুই বা ক্ষমতা তার উপকার করা বা ক্ষতি করার। সব কিছু ঘটে একরকম তার নাগালের বাইরে, দু-চারটে নোট তার হাতে পুঁজে দেওয়া হয়। সে যাতে কোনো গোলমাল না করে, চুপ করে থাকে। মুখটা বন্ধ করে রাখার পুরস্কার ওটা। কেন তবে সে বাহাদুরি করতে যায় ? টাকার কৃতজ্ঞতায় ? অথবা ওপরওয়ালাকে জানিয়ে দিতে, আমিও আছি। এর মধ্যে, কিন্তু ভয় পাবেন না, আমি আপনার অনুগত, আপনারই পক্ষে ? হয়তো ভালোই হয়েছে। ফলটা। তাকে যে বিশ্বাস করে ওপর থেকে, তার তো প্ৰমাণই পাওয়া গেল। কিন্তু উপার্জনটা বড়ো কমে গেছে এই বিশ্বাসের বোঝায়। এই কাজে এসে উপরি তেমন জুটছে না। আগেকার বাটোয়ারার জের টেনে কিংবা নায়েবের সঙ্গে এখনও তার খাতির আছে। এই জন্য ভিক্ষার মতো কিছু যদি কেউ দেয়। বিশেষ কিন্তু আপশোশ হয়নি। শশাঙ্কের। মনটা তার চিরদিনই একটু স্পর্শপ্রবণ ছিল, চারিদিকের আকাশছোঁয়া লোভ ও স্বার্থপরতার চাপে কঠিন হয়ে গেলেও এখনও দুঃখের ছোঁয়া লেগে তাকে একটু উন্মনা করে দেয়। অস্তরের এই বিলাসিতটুকু সযত্নে বঁচিয়ে সে পুষে রেখেছে, সময় ও সুযোগ মতো উপভোগ করে। চারিদিকে অনাহারে মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা চোখে দেখে এবং বর্ণনা শুনে ও পড়ে সে দুঃখিত হতে সাহস পায়নি, নিজেকে উদাসীন করে রেখে দিয়েছে। আনমনা হয়ে মানুষ পুত্ৰশোক ভুলে যেতে পারে, এ তো পরের, গরিবদুঃখীর না খেয়ে মরার জন্য সমবেদনা বোধ করা । এখন আর অতটা মনকে বঁচিয়ে চলবার দরকার হয় না। শশাঙ্কের, খেতে না পেলে ক্ৰমে ক্ৰমে নানা বয়সের মানুষের কী অবস্থা হয়, কী অবস্থায় তারা মরে পড়ে থাকে পথের ধারে, এ সব এখন সে চোখ মেলে চেয়ে দেখতে পারে, দীর্ঘনিশ্বাসও ফেলতে পারে। তেত্ৰিশ হাজার মন খাদ্য তার মনে এই জোরের সঞ্চার করছে। এই বিরাট খাদ্যভান্ডারের সংস্পর্শে থেকে সে অনুভব করে, আর ভাবনা নেই, না খেয়ে এবার আর মরবে না কেউ এ শহরে বা আশেপাশের গ্রামে। কে পেট ভরে খেল। কার আধাপেটা জুটল সে হিসেব চুলোয় যাক, না খেয়ে কেউ আর মরবে না। এত খাদ্য থাকতে । টিনের ফুটাে আর ফাক দিয়ে খাদ্যের গন্ধ প্রতিদিন নাকে এসে লাগে শশাঙ্কের, খাদ্যবস্তুর এই অবিস্মরণীয় ঘনিষ্ঠতায় তার হূদয় স্বস্তিতে ভরে যায় : হাজার হাজার মানুষকে বঁচিয়ে রাখবে এই খাদ্য দুদিন পার করে দেবে। মানিক ৫ম-২৩