পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/৪৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

फ्रिश् 8 ○> জয়স্তের মনে শুধু এই ভয়, বাড়ি ফিরলে মা বকবে। আর সব ভয়-ডর সে ভুলে গেছে। সে আর তার দশ-বারোজন। সঙ্গী আজ পৃথিবী জয় করতে পারে। পাড়ার এই ছেলেদের সঙ্গে কত রকম খেলা সে খেলেছে, কত অ্যাডভেঞ্চার করেছে রায়বাবুদের বাড়ির সামনের লোহার গেট ও প্রাচীর ঘেরা ছোটাে বাগানের ফুল চুরি করা থেকে বগলস খুলে ডিকসনের কুকুরটাকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া পর্যস্ত, বারো বছর বয়সের জীবনে আজকের মতো এমন উত্তেজনা এমন উন্মাদনা আর কোনোদিন সে পায়নি। এদিক ওদিক একটু ঘুরে দেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবে বলেই সে বেরিয়েছিল, শিশির, মনা, অশোকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বেলা দুপুর হয়ে এল, এখনও তারা ফিরতে পারেনি। বড়ো মোড়ে মিলিটারি লরিটাতে আগুন ধরামাত্র ওখানে ছুটে গিয়েছিল দল বেঁধে দেখতে, তারপর চারটি লরি পোড়ানো দেখে এতক্ষণে তারা পাড়ার গলির মোড়ে ফিরে এসেছে। তার আগে কি ফেরা যায় ? বাড়িতে নয় একটু বকবেই। হাজার হাজার লোকে যখন রাস্তায় নেমে এসেছে, একটি গাড়ি পর্যন্ত চলতে দেবে না পণ করে, সে কী করে বাড়ি ফেরে। শিশির জিজ্ঞেস করেছিল, কেন গাড়ি চলবে না ভাই ? জয়ন্ত--"তেরো বছরের জয়ন্ত, ন বছরের ছেলের প্রশ্নে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল, জিনিস না ? গুলি করবে। কেন ? এটা আমাদের দেশ, আমরা যা খুশি করব। ওরা গুলি করবে। কেন ? অশোক বলেছিল, তাছাড়া, আমাদের স্বাধীনতা চাই তো। পরাধীন হয়ে থাকব কেন শুনি ? মনা সায় দিয়েছিল, বাবা বলে, আমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করি, তাই স্বাধীনতা পাই না। আমরা তাই এক হয়েছি। দেখছিস না ? এই দ্যাখ। বিক্ষুব্ধ জনতাকে শাস্ত করার জন্য শাস্তি বাহিনীর একটি গাড়ি তিন দলের পতাকা উড়িয়ে মোড়ের মাথায় থেমেছিল, লাউড স্পিকার থেকে ভেসে এসেছিল : সংযম হারালে, দুচারখানা গাড়ি পোড়ালে, অন্যায়ের প্রতিকার হবে না, স্বাধীনতা আসবে না। শাস্ত হয়ে সকলে বাড়ি ফিরে যান, কিংবা প্রতিবাদ সভায় যোগ দিন। সংঘবদ্ধ আন্দোলনে দাবি আদায় করুন। জয়ন্ত বলেছিল, তোকে বলিনি ঢ়িল ছুড়িসা না মনা ? শূনলি তো ! তারপর তারা ফিরে এসেছে এই গলির মোড়ে। গলা শুকিয়ে গেছে তাদের ইনক্লাব, জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম চেচিয়ে চেচিয়ে। বড়োদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা চেচিয়েছে, তারা তো তুচ্ছ নয়। খিদেয় অবসন্ন হয়ে এসেছে শরীর। তবু গলির ভেতরে ঢুকে যে যার বাড়ি চলে যাবে সে ক্ষমতা যেন পাচ্ছে না। তারা। তাদের শিশু মনের স্বপ্ন, আর বৃপকথা যেন বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে আজ। তাদের সামনে শহরের রাজপথে, অফুরন্ত সুযোগ জুটেছে রাজপুত্রের মতো বীরত্ব দেখাবার। এ মোড়ের অল্পদূরে, একটা লরি পুড়ছিল। তাই দেখার জন্য তারা দাঁড়িয়ে থাকে। সৈন্যবোঝাই একটি লরি আসছে দেখা যায়, শব্দও পৌঁছায় এখানে । জয়ন্ত বলে দৃঢ়স্বরে, সৈন্যবাহিনীর কম্যান্ডারের মতো, এই শেষবার। এদের শুনিয়ে দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরব। আমি যা বলব, তোমরা ঠিক তাই বলবে। দু-তিন পা এগিয়ে দাঁড়াই চলো। রেডি ! ইনক্লাব জিন্দাবাদ। জয় হিন্দ। বন্দে মাতরম। ইনক্লাব মনার গায়ে ঢলে জয়ন্ত রাস্তায় আছড়ে পড়ে। উঠবার যেন চেষ্টা করছে এমনি করে নড়েচড়ে কয়েকবার। দুবার কাশে রক্ত তুলে। তারপর নিস্পন্দ হয়ে যায়। তেরোটি শিশু তাকে ধরাধরি করে গলির ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাড়ির সামনের প্রথম যে বারান্দা মেলে তাতে শুইয়ে দেয়। অনুবৃপা তখন ধৈর্য হারিয়ে ছেলের খোঁজে গলি দিয়ে এগিয়ে আসছিলেন।