পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/৪৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8V -ы মানিক রচনাসমগ্ৰ হাসপাতালে। আহত একটি ছেলের আত্মীয়ের আসবার কথা ছিল, অজয় স্টেশনে এসেছিল তাকে ছেলেটির খবর জানিয়ে দিয়ে যাবার জন্য। ছেলেটির অবস্থা ভালো নয়। আত্মীয়টি আসেননি, অথবা এসে থাকলেও চেহারার বর্ণনা শূনে চিনে উঠতে পারেনি। ফিরবার সময় পুল পার হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত অসহনীয় দৃশ্য দেখছিল অজয়। ভিড় সরে এসে জমা হয়েছে এ পাশে, ও পাশের রাস্তা দিয়ে লোক চলছে খুব কম-জাবুরি দরকার না থাকলে ওপথে প্রাণ হাতে করে অকারণে কে চলতে চাইবে। ইট পাটকেলে ভর্তি হয়ে আছে রাস্তাটা, সেই রাস্তা সাফ করছে। দশ-বারো জন ভদ্রলোক। ওদের ধরে জোর করে রাস্তা সাফ করানো হচ্ছে। সাদা নীল স্ট্রাইপ কাটা শার্ট গায়ে এক ভদ্র যুবককে বেঁটে লালচে গােঁফওলা একজন অফিসার ফুটপাথ থেকে টেনে নামিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে লাগিয়ে দিল। ওরা কি জানে না মুখ বুজে। এ জুলুম সহ্য করা পাপ ? কী বলে ওরা সুকুম পেল আর ইট পাটকেল সরাবার কাজে লেগে গেল ? অজয়ের মনে হয়, ওরা যে মুখ বুজে এ অপমান সইছে এ জন্য দায়ি সে। তারও তো এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া বিশেষ দরকার, কিন্তু হাঙ্গামার ভয়েই তো না এগিয়ে এতক্ষণে সে দাঁড়িয়ে আছে হাঁ করে। লোক চলছে ও রাস্তায়, সবাইকে ধরে রাস্তা সাফের কাজে লাগাচ্ছে না। যদি তাকে ধরে, এই তো তার ভাবনা। সে তো কোনোমতেই হুকুম শূনে ইটপাটকেল সাফ করার কাজে লেগে যেতে পারবে না। ওই ভদ্রলোক কজনের মতো। তাহলেই তখন গোল বাধবে } কিন্তু তাই বলে কি দাঁড়িয়ে থাকা যায় ভীৰু কাপুরুষেব মতো ? সে হাঙ্গামা করতে আসেনি, কাজে এসেছে। ও রাস্তায় লোক চলা নিষিদ্ধ হয়নি। তার হেঁটে যাবার অধিকার আছে ও রাস্তা দিয়ে। সে যদি অন্যায় না করতে, অধিকার বজায় রাখতে ভয় পায়, ওরা ইটপাটকেল সাফ করতে লেগে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কি ? অজয় এগিয়ে যায়। হাঁই ! বলে। লালচে গোফওলা অফিসার, কাছে এসে সোজা সহজ হুকুম জারি করে, সাফ করো। অজয় প্রশ্ন করে, এ রাস্তায় কি ট্র্যাফিক বন্ধ ? প্রশ্ন শূনেই বোধ হয় রেগে যায় লালচে গোঁফ, আর রেগে যায় বলে ধৈর্য ধরে বলে, সাফ করো। সাফ করো। তুম ইটা ফিক, তুমি সাফ করোগে। ইউ আর ম্যান্ড। অজয় বলে। তখন দুহাতে ধাক্কা দিয়ে অজয়কে সে ফেলে দেয় রাস্তায়। মাথায় সামান্য একটু চোট লাগে অজয়ের। yান হাতের কাছে একটিইট। মাটি পােড়ানােইট নয়, শক্ত পাথুরে ইট, যা দিয়ে রাস্তা বাঁধায়। চোখে অন্ধকার দেখছে অজয়। কয়েক মুহুর্তের জন্য সে এখন উন্মাদ। হাতে তার জোর আছে। এই ইটটা ছুড়ে মেরে সে মাথার ঘিলু বার করে দিতে পারে লালচে গোঁফের। তারপর যা হয় হবে। না। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে অজয় বলে, না। সে ভদ্রলোকের ছেলে, কে একজন তাকে অপমান করেছে, এই ব্যক্তিগত আক্ৰোশে অন্ধ হয়ে কিছু তার করা চলবে না। হাসপাতালের আহত ছেলেদের মুখ তার মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাস্তায় বসা একদল তরুণের মুখ। না, নরক থেকে শয়তান এসে তাকে বিগড়েবার চেষ্টা করলেও সে খাঁটি থাকবে। সে সংযত থাকবে। সে শাস্ত থাকবে। ধীরে ধীরে অজয় উঠে দাঁড়ায়। বঁ হাতটা কি ভেঙে গেছে ? গেছে। যদি যাক, এখন তা ভাববার সময় নয়, ভাঙা হাত জোড়া লাগবে। লাল গোফ তাকিয়ে থাকে। সিমেন্টের শক্ত ইটটা সে দেখেছে, অজয় যখন ইটটা নামিয়ে রাখছে। তার মাথায় ছুড়ে মারবার জন্য ইটটা তুলেছিল। মারল না কেন ? ও ইট মাথায় লাগলে সে বঁািচত না। কিন্তু মারল না কেন ? লালগোফ বোধ হয় বুঝে উঠতে পারে না, তাই তাকিয়ে থাকে।