পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শহরবাসের ইতিকথা ፭S¢ পুরানাে নেশার ঘোর কাটিয়া যাইতেছে, পচা বাঁধন খসিয়া পড়িতেছে—সে মুক্তি পাইতেছে নূতন জীবনের স্বাদ গন্ধও মিলিতেছে। জ্যোতির সঙ্গে আর তেমন তার বনিবনা নাই। নতুন সাঙত জুটিয়াছে। কারখানায় তার সহকমী ভূপাল। জ্যোতির সঙ্গে কীভাবে গড়িয়া উঠিয়াছিল সাঙাতি আর ভূপালের সঙ্গে কীভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে আঁততি । কাজে ভর্তি হইয়া শ্ৰীপতি ভয়ে ভয়ে প্ৰাণপণে কাজ শিখিয়া কাজ করিবার চেষ্টা করিত, এক মুহূর্তের জন্য ভুলিতে পারিত না সে গেয়ো কামার। সহকমীদের চালচলন কথাবার্তা প্ৰায় কিছুই বুঝিত না। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হইবার কোনো চেষ্টাই করিত না। কোনো রকমে শুধু মানাইয়া চলিত। এদের সঙ্গে উদয়াস্ত খাটিবে, কাজের জন্য দরকারি সম্পর্ক রাখিবে কিন্তু এই সব শহুরে পাকা ঝানু মজুরের সঙ্গে তার কি সমঝাওতা করা চলে। শহুরে সােঙাত জ্যোতি। মোহনের বাড়ির চাকর হইয়াও ফরসা হাফ শার্ট আর ধুতি পরে, পায়ে স্যান্ডেল দেয়, পাঁচীর ঘরে টানিয়া লইয়া গিয়া মদ খাওয়ায় গান শোনায়—শ্ৰীপতি বুঝিয়া উঠিতে পারিত না কোন ভাগ্যে তার এমন শহুরে বন্ধু জুটিয়াছে শহরে আসিয়াই ! প্রথম প্রথম জ্যোতির মুখে বড়ো বড়ো লোকের বাড়ি চাকরি করা আর একধার হইতে বাড়ির মেয়ে বউলের সঙ্গে পীড়িত করার অশ্লীল গল্প শুনিতে শুনিতে শ্ৰীপতির মনে হইত, কলির কোনো দেবতা কি পৃথিবীতে জন্ম নিয়া শৌখিন বাড়ির শৌখিন চাকরের বেশে লীলা খেলা করিতেছেন ! শুধু পাঁচীর ঘরে গিয়া মাতলামির লীলাখেলা করার বেঁকাঁটার জন্য সে তাকে চাকররূপী দেবতা বলিয়া মানিতে পারে নাই। এখন সে টের পাইয়া গিয়াছে যে জ্যোতির দৌড় বস্তির ওই সস্তা পাঁচী পর্যন্তই। বয়স কম, চেহারায় জলুস আছে, চাকরের কাজে ঢুকিয়া দু একটা বাড়িতে দু একটা কেলেঙ্কারি হয়তো করিয়া থাকিতে পারে-একধার হইতে ভদ্রঘরের বালিকা তরুণী বয়স্কা নারীর হৃদয়রাজ্য জয় করিবার উদ্ভট উৎকট কাহিনিগুলি সবই তার বানানো। নিজের মনের বিকারকে খাতির করিবার জন্য বানানো। তার মতো গেয়ো সরল মানুষকে শ্রোতা হিসাবে না পাইলে তাই তার মিথ্যা গল্প বলার রস জমে না। হাতে পয়সা থাকিলে সে পাঁচীদের ঘরে গিয়া মাতলামি আর হল্লার লীলাখেলা করে, পয়সা না থাকিলে মন-মরা হইয়া তাকে উৎকট বীভৎস রসে রসাইয়া রাসাইয়া গল্প বলিয়া নিজের বিকারকে সামলানোর চেষ্টা করে। শুনিতে শুনিতে বিচলিত অভিভূত হইয়া যাইত ভাবিলে এখন শ্ৰীপতির নিজের গ্রাম্যতার অজ্ঞতায় লজ্জা বোধ হয়, হাসি পায় { একটা গেয়ো বউ কদমের তাল সামলাইতে তার প্রাণাস্ত হয়, দুৰ্গাকে পর্যন্ত ছটিয়া ফেলিতে হয়-মোহনের পেয়ারের চাকর বলিয়া এবং চেহারায় একটু জালুস আছে বলিয়া জ্যোতির বেলা যেন প্ৰেম করিতে গেলে দায় ঘাড়ে করার নিয়মটা পাতিল হইয়া যাইবে। বোকা । গ্রামে থাকিতে শ্ৰীপতি বিশ্বাস করিত, দাম দিয়া পীরিত হয় না। এখন সে জানিয়া গিয়াছে পীরিত করার দামও পুরুষকে দিতে হয় । জানিয়া কত দিক দিয়া যে সে স্বস্তি বোধ করিয়াছে !