পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in > > ケ মানিক রচনাসমগ্ৰ তাই নাকি ? তা হইবে! বকুল চলিয়া গেল, বউ চলিয়া গেল, বিবাহ বাড়ি নিঝুম হইয়া আসিল, রহিয়া গেল মন্দা। এই তো সেদিন শ্যামা মন্দার আশ্রয় ছাড়িয়া আসিয়াছে, দাসীর মতো খাটিয়াছে মন্দার সংসারে, অহােরাত্ৰ মন জুগাইয়া চলিয়াছে, সে স্মৃতি ভুলিবার নয়। একবিন্দু কৃতজ্ঞতা নাই শ্যামার, মন্দা রহিয়া গেল বলিয়া সে এতটুকু কৃতাৰ্থ হইয়া গেল না। কয়েক বছর আশ্রয় দিয়াছিল বলিয়া শ্যামার কাছে কী সমাদর মন্দা আশা কবিযাছিল। সেই জানে, বোধ হয়। ভাবিয়াছিল আজও শ্যামার উপর কর্তৃত্ব করিতে পরিবে। কিন্তু সে না পাইল মনের মতো সমাদর, না পারিল কোনোদিকে কর্তৃত্ব করিতে। শ্যামার সংসারে কী কর্তৃত্ব আব্ব সে করিতে চাহিবে, ভালো করিয়া আবার শীতলের চিকিৎসা করানাের জন্যই তাহার উৎসাহ দেখা গেল সব চেয়ে বেশি। বলিল, রয়ে কী গেলাম সাধো ? কী করে রেখেছি তোমবা দাদাকে। দাদাকে ভালো না করে আমি এখান থেকে নড়ছিনে বউ ! কত সে দাবদি বোন, কত তীব ভাবনা। কে জানে, হইতেও পারে। আজ তো সপুত্র সকন্যা শ্যামাব ভবিষ্যৎ অন্ধকার নয়, কিছুই তো ওদের জন্য আর তাঁহাকে কবিতে হইবে না, শীতলের জন্য হয়তো তাই আন্তরিক ব্যাকুলতাই মন্দার জাগিয়াছে। শ্যামাকে সে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। শ্যামা বলিল, ওর আবি চিকিচ্ছে নেই। ঠাকুরঝি, ওর চিকিচ্ছে এখন সেবাযত্ন । মন্দা স্তম্ভিত হইয়া বলিল, মুখ ফুটে এমন কথা তুমি বলতে পারলে বউ ; তুমি কী গো, আঁ্যা ? শ্যামা বলিল, কী বলতে হবে তুমিই না হয় তবে বলে দাও ? মন্দা রাগিয়া উঠিল, কঁদিয়াও ফেলিল। কে জানে অকৃত্রিম বেদনায় মন্দা কাতর হইযাছে কিনা। এ তো অর্থসাহায্যের কথা নয়, ভারবহনের কথা নয়, ভাইয়ের জীবন তাহার। চিকিৎসা নাই, ভাই তাহার বাঁচিবে না ? মন্দার হয়তো ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। শীতলের অসংখ্য পাগলামি আর অজস্র স্নেহ,- বড়ো ভালোবাসিত শীতল তাহাকে। সেই দিনগুলি কোথায় হারাইয়া গিযাছে, কিন্তু এই বাড়িতেই সে সব ঘটিয়াছিল। এখানে বসিয়া অনায়াসে কল্পনা করা চলে সে সব ইতিহাস। হয় তো। তাই মন্দার কান্না আসে। বলে দাদাবী জন্যে কিছুই করবে না। তুমি ? ডাক্তার-কবরেজ দেখাবে না ? শ্যামা বলে, ডাক্তাব কি দেখানো হয়নি ঠাকুরঝি ? ডাক্তার না দেখিয়ে চুপ করে বসে আছি আমি ? ষোলো টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার এনেছি, কলকাতার সেরা কবরেজকে দেখিয়েছি।--জবাব দিয়েছে সবাই। আমি আর কী করব ? তবে আর কী, কর্তব্য করেছ এবার টান দিয়ে ফেলে দাও দাদাকে রাস্তায়! আজি বুঝতে পারছি বউ দাদা কেন বিবাগি হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এতকাল পরে মন্দা। তবে শ্যামাকে চিনিতে পারিয়াছে ? শীতলেব পায়েব কাছে বসিয়া মন্দা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। চমকাইয়া উঠিয়া বড়ো ভয় পায় শীতল। দাদা গো! বলিয়া মন্দা হাউহাউ করিয়া কঁাদিয়া ওঠে। শীতল থারথার করিয়া কঁাপিতে থাকে। মনে হয়। আর কিছুদিন যদি বা সে বঁাচিত মন্দার বুকফাটা কান্নায় এখুনি মরিযা যাইবে। বড়ো কষ্ট হয়। শীতলের, বড়ো ভয় করে। বড়ো বড়ো কালো লোমশ পা ফেলিয়া নিজের মরণকে সে যেন আগাইয়া আসিতে দেখিতে পায়। বিহুল দৃষ্টিতে সে চাহিয়া থাকে মন্দার দিকে ।