পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in অতসী মামি SVS শিক্ষা-দীক্ষা সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল তোমার সঙ্গে পরিচয়ের আগে। কিন্তু তোমার ছেলেরা ভালোমন্দ কোনো শিক্ষা নিয়েই জন্মায়নি। তাদের তুমি মানুষ করে গড়ে তুললে না কেন? নিজেই বললে তোমার শক্তি সামান্য। সামান্য শক্তি এত বড়ো দেশে ছড়িয়ে দিয়ে কী লাভ হবে? দুটি ঘুমন্ত দেশসেবককে জাগাতে পারলে সব চেয়ে বড়ো দেশসেবা হত না ? কেন তা করলে না ? কেন কবলাম না ? পারলাম। কই ? খাচার শিকে শিকে বাধা পেলাম। কোলের ছেলে যখন এক বছরেরও নয়, গৰ্ভে ছেলে এল। সকাল-সন্ধ্যা রান্নাঘরে কাটল, বাকি সময় নানা কাজে । অভাবেব খোঁচায় মাথায় ঘা হয়ে গেল, চিন্তার বিষে অবসন্নতা ও অবহেলা এল। যেটুকু সময় ও সাধ্য হাতে বইল, স্বার্থপব স্বামী ছিনিয়ে নিল। তবু আমি পারতাম। অতিমানুষ না করতে পারি অমানুষ হতে দিতাম না, যদি ওদের জীবন বিষাক্ত আবহাওয়ায় বিযিয়ে না যেত। চব্বিশ ঘণ্টা পলে পলে যাদের জীবন বিকৃত হয়, পাঁচ মিনিটের চেষ্টায় আমি তাদের কী করতে পারি ? জন্ম থেকেই ওরা অভিশপ্ত। বাপের অসংযমে জন্মাল বুগণ হয়ে, খাদ্যের অপ্রাচুর্যে দেহ-মন কুঁকড়ে গেল, বিকাশ হল না, জীবনীশক্তির অভাবে ক্ৰমাগত রোগে ভুগল, দোষে বিনাদোযে বাপের ছ্যাচ খেয়ে কুটিলতা শিখল, শিশুমনের তুচ্ছতম আকাঙক্ষাটি অতৃপ্ত থাকায় চুরি শিখল, বাডির ভয় ও নিরানন্দের আবহাওয়ায় মন না টেকায বেশি সময বাইরে কাটাতে ভালোবাসল, যার তার সঙেগ মিশে অসৎসঙ্গের অশেষ দোষ সঞ্চয় করল, পযসা আর খাবারের লোভে বজাত লোকের কাছে কামুকতার দীক্ষা পেল। এ তো সংক্ষিপ্ত হিসাব, আবও কত আছে। এবার বুঝলে কোন পারলাম না ? আমি কতক্ষণ কথা বলতে পাবলাম না। এ কী বর্ণনা, এ কী নালিশ! মনের জ্বালা কি শব্দের বুপ নিতে পাবে ? অত্যুক্তি মনে করার চেষ্টায় আমি ব্যৰ্থ হলাম, আমার কোনো সান্তনা বইল না। শুধু মুখের কথা তো নয় যে, শোনার সঙ্গে হৃদয়ের যোগাযোগ কম বেশি করে যতটুকু মানলে মনের স্বস্তি ততটুকু মানব। সন্তানহাবা মা আমার সামনেই বসেছিল। অত্যুক্তি যদি, ও কেন ছেলে ফেলে এল! সন্তান হাবানোবা চরম প্রমাণেই যে ও প্রমাণ কবেছে অভিযোগ বাড়িয়ে বলা নয়! সে বললে, অনেক দুঃখেই বাড়ি ছেড়েছি ভাই। আমি অভিশপ্ত স্ত্রী ও জননী, আমার সন্তান দেশেব অভিশাপ, জীবনেব। এমন অসামঞ্জস্য বরদাস্ত হল না। আমি মুক্তি নিলাম। এ মুক্তি সময় সময় পীড়া দেয়, এগারো বছরেব চেনা খাঁচার ডাক আমি শনতে পাই। আমার বুক ফেটে যায়। আমি যাতনাযা ছটফট কবি। কতক্ষণেব জন্য দেশের সেবায দারুণ বিরাগ জন্মে। মনে হয়, নু্যত্তজ হযে পথের ধুলোয় চোখ বুলিয়ে চলতে দেশের মানুষ যদি ভালোবাসে, ভালোবাসুক , সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুক্ত নীলাকাশের দিকে না তাকাতে চায় না। চাক –আমােব কী? আমি কেন মাতৃত্বের আত্মহত্যা দিয়ে এমন নিষ্ঠব পুজো কবে চলি ? কিন্তু এ দুর্বলতা কেটে যায়, মুক্তির পীড়ন গর্ব ও আনন্দ হয়ে ওঠে। আমি বললাম, দেশে অসংখ্য পুরুষ দিদি। তরুণ তরুণীতে দেশ ভরা। তোমার মতো তারা মাটিতে শিকড়-বসা। তবু নয়। নিজেকে উপড়ে তুলে এই অস্বাভাবিক ত্যাগ তোমার করতে হবে কেন? তুমি ফিরে যাও। সে হাসল। -সংখ্যাব গর্বে দেখি ফেটে পড়ছ! প্রমাণ কই? তুমি আমায় বুঝিয়ে দিতে পারবে যে আমি অনাবশ্যক অতিরিক্ত বাহুল্য ? যদি পাের, এখুনি ফিরে যাব। সতিনকে পর্যন্ত ভয্য করব না। একটু থেমে বললে, তুমিও তো পুরুষ, না ভাই? শিকড়হীন পুরুষ! কেবল কলেজ ডিঙিয়ে শিকড় গাড়বার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছ, এই যা আপশোশ। একটি বাড়ি, টুকটুকে একটি বউ, চাঁদের টুকরো একটি ছেলে। খাসা শিকড়। না? লোভীী! আমি ক্ষুন্ন হয়ে বললাম, অনেক আগে ঘাট মেনেছি, খোঁচােচ্ছ কেন?