পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in শিপ্রার অপমৃত্যু এবার, ছত্রিশ সালের এই মহাপূজার সময় পরাশর, শিপ্রা ও অনিন্দিতা পদ্মাতীরের কোকিনদে একত্ৰ হয়েছে। অনিন্দিতার গ্রামে আসবার কারণটির মধ্যে কোনো বিশেষত্ব নেই। তবে আত্মীয়স্বজন কয়েক বছর ধরে বসবাস করছেন দেশে। কলেজের ছুটি হলে শিপ্রাও আত্মীয়স্বজনের কাছে এসে থাকতেই ठानांदन । পরাশর এসেছে তার বাবার কাছে থেকে কিছু টাকা আদায়ের চেষ্টায়। এবাব তার ধারটা হয়েছে বেশি। বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত পরপর দুটি সোসাইটি গার্লের বিলাসিতর খরচ জোগানো সহজ কথা নয়। যথেষ্ট কৃপণতা করেও পরাশরের ধার না করে চলেনি। মেয়ে দুটির সঙ্গে একে একে তার বিচ্ছেদ হযেছে, ছ। মাসের মধ্যে দুটি অস্ত্ৰোপচার। ক্ষতেব চিহ্ন অবশ্য লোপ পেয়েছে একমাসের মধ্যেই কিন্তু ধারটা বেঁচে থেকে সুদে বেড়েছে। আগে পরাশরের ভাবনা ছিল না। চিঠি লিখে টাকাটা চেয়ে পাঠালেই জবাবে কিছু গালাগালি দিয়ে মধু বোস তাকে টাকা পাঠিয়ে দিত। এখন সে সহজে টাকা দিতে চায না। বুড়ো হয়ে মধু বোস হয়েছে ভারী কৃপণ, বেশি টাকা চাইলে রেগে যায়। স্পষ্ট বলে, দেব না, দরকার থাকে বোজগার করে নাও গে। তার এই সুস্পষ্ট না-কে হঁী তে পরিণত করতে মারি সাহায্যে পরাশরের অনেক কাঠ-খড়ি পোড়াতে হয়। সে এত বেশি আরামপ্ৰিয অলস প্রকৃতির লোক যে কোনো ব্যাপারে কাঠ-খড়ি পোড়ানো আর নিজেকে পোড়ানোর মধ্যে তার বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে না । -ኛ o মাকে পত্র লিখলে মা জবাবে লেখেন : এক বছরের বেশি বিনা কাজে কলকাতায় বসে আছে। কখনও চিঠিপত্র লেখ না। উনি বড়ো রেগে আছেন। তুমি একবার বাডি এলে টাকার কথা বলতে পারি। ইতি মা । সুতরাং শুধু বাবা নয়, মাও ভয়ানক রেগে আছেন বুঝতে পেরে পবাশরকে গ্রামে আসতে হয়। দিন পনেরোর জন্য জীবনটা ব্রেক কষে থেমে থাকে। জগৎ জুডে থাকে। শুধু একটা গতিহীন স্তব্ধ বিষন্নতা। শিপ্রার কোকিনদে আসবার কারণটি পুরোনো। সে শহরের মেয়ে। শহরের রাশি রাশি ইটের আনাচে-কানাচে নিশ্বাস ফেলে সে বড়ো হয়েছে। সংকীর্ণ গৃহ, সীমাবদ্ধ আকাশ, শুধু সম্মুখ ও পিছন-থাকা পথ, পুনবাবর্তিত কর্তব্য ও অবকাশ! সব জড়িয়ে বাহান্নটি সপ্তাহে তার বছর, এ বছরের সঙ্গে ও বছরের কোনো পার্থক্য নেই। বেড়াতে যদি সে কখনও যায় তো মাইনের টাকা বঁচিয়ে হয় একা, নয়। দু-চারজন বন্ধুর সঙ্গে যায় পশ্চিম, যায় পুরী। পাহাড়ের বন্ধুর পথে হেঁটে বেড়িয়ে সে হাঁপায়, সমুদ্রতীরে বালিতে লুটােপুটি খেয়ে সমুদ্রস্নান করে আর সর্বদা আধা-আধা অনমনস্ক হয়ে হতাশ অবসন্ন হ্রদয়ে ভাবে, সমস্ত জীবনটার মতো এবারের ছুটিটাও তার মাঠে মারা গেল। তারপর একদিন সে মরিয়া হয়ে চলে যায়। তার পিসিমার কাছে হাজারিবাগে। কয়েকদিন বাড়ির রান্না ঝোল-ভাত খেয়ে বর্ধিত রক্তের রঙে চামড়ার ধবধবে সাদা রংটা একটু রঙিন করে এনে এবং দু-চারদিন বনে-জঙ্গলে পিকনিক করে ফেরে কলকাতায়। সেখানে ছুটির বাকি কটা দিন ঝিমিয়ে স্কুল খুললে রোজ চার ঘণ্টা সিক্সথ ক্লাস থেকে ফাস্ট ক্লাস অবধি বাংলা পড়িয়ে যায়।