পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in সপিল প্রান্তরের প্রান্ত মিলিতে বেলা চারিটা বাজিয়া গেল। গ্রামে প্রবেশ করিবার আগে পালকি থামাইয়া অনন্ত একবার নামিয়া পড়িল, দাঁড়াইল প্ৰান্তরের দিকে মুখ করিয়া। অতিক্ৰান্ত পথটি বহুদূর অবধি নজরে পড়ে। যে নিঃসঙ্গ বটগাছটি অনেকক্ষণ আগে ছাড়াইয়া আসিয়াছিল, এতদূর হইতে তার অবস্থান আরও করুণ ও রহস্যময় মনে হয়। তার পর দিগন্তে মেশানো পৃথিবীর সীমা। বেলা দশটায় যে ক্ষুদ্র স্টেশনটিতে সে অবতরণ করিযাছিল, তাহাকে অনুসরণ করিয়াই যেন ওই দিগন্ত সেই স্টেশনটি পার হইয়া আসিােয়ছে। ডাহিনে বামে অর্ধচক্রাকার তরুশ্রেণি, পাশাপাশি প্রান্তরটির বিস্তার তিন-চার মাইলের বেশি হইবে না। অদূরে প্রকাণ্ড একটা দীঘির জল চকচক করিতেছে। তাঁহারই তীরে কোনো কৃষকের অস্থায়ী হােগলার ঘর। দিবারাত্রি ওই ঘরে থাকিয়া সে তাহার শস্যভরা কয়েক বিঘা পৃথিবীকে পাহাবা দেয়। করতলের ছায়ায় চক্ষুকে আশ্রয় দিয়া অনন্ত চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। পত্র লিখিয়া কেতকী তাহাকে এত দূরে এমন দুৰ্গম গ্রামে টানিয়া আনিবে কে ভাবিয়াছিল! কিন্তু দুৰ্গম গ্রামেও পালকি থামিল না। গ্রামবাসীর বিস্মিত দৃষ্টি ও কুকুরজাতীয় কতকগুলি জন্তুর সচিৎকার অভিনন্দন সংগ্ৰহ করিয়া গ্রাম ছাড়াইয়া পালকি জঙ্গলাকীর্ণ কঁচাপথ ধরিল। থামিল আরও প্ৰায় আধ মাইল গিয়া। কেতকীই পালকি বেহােরা পাঠাইয়াছিল, সুতরাং ভুল হইবার কথা নয়। সম্মুখেই কেতকীর আধুনিক বাসগৃহ। কিন্তু গৃহ বলিয়া চেনা কঠিন। এ যেন বৃপধরা পুরাতত্ত্ব। সেকেলে তিনিমহাল বাড়ি, একসারিতে খানচারেক ঘর ছাড়া বাকি সমস্তটাই প্ৰায ভাঙিয়া পডিয়াছে। এখানে দাঁড়াইযা আছে খানিকটা ভাঙা দেওয়াল, ওখানে বুলিতেছে ছাদের একটু অংশ ও কড়িবৰ্গর কঙ্কাল,—যে প্রাচীর একদিন গৃহটিকে আড়াল করিয়া রাখিত তাহার চিহ্নমাত্র নাই। চারিদিকে শুধু ইটের স্তুপ ও আগাছার জঙ্গল। দেউড়িটা বিপজ্জনক অবস্থায় কোনোমতে খাড়া আছে। দেউড়িটার সামনে একটি বৃহৎ অশ্বখ তরু বিস্তুত ছায়া ফেলিয়া স্থানটির অস্বাভাবিক স্তব্ধতা দ্বিগুণ নিবিড় করিয়া তুলিয়াছে। অদূরে একটি মন্দির। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় মন্দিরটি বেশি পুরাতন নয়, কিন্তু ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিলে ভুল ভাঙে। বুঝিতে পারা যায়, মানুষের যে গৃহ আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হইয়া গিয়াছে, দেবতার এই আবাসটির বয়স তার চেয়ে কম নয়। কিন্তু আজও জীৰ্ণতা দেখা দেয় নাই, একটি ইটও খসিয়া পড়ে নাই। কাল যেন দেবতার ভয়ে মন্দিরকে শুধু স্পর্শ করিয়া গিয়াছে, আঘাত করে নাই। সিঁড়িটা ভাঙিয়া গিয়াছে। কিন্তু সে কীর্তি কালের নয়। কত কাল ধরিয়া কত মানুষের পায়ের আঘাত সিঁড়িটা সহিয়াছে তার ঠিকানা নাই। তাহা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মানুষ যে দেবতার কাছে পোঁছবার কাজে তাহাকে লাগাইতে পারে এইটুকুই আশ্চর্য। নিবিষ্ট চিত্তে মন্দির দেখিবার ফাকে কখন কেতকী আসিয়া নিকটে দাঁড়াইয়াছিল অনন্ত টের পায় নাই। কেতকী কথা বলিতে সে একটু চমকিয়া উঠিল।