পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in অতসী মামি ՏԵՂ একটি আস্ত টালি। বুকের বেদনা বিস্মৃত হইয়া সে তড়িদবেগে উঠিয়া বসে। এবার আর তার বুঝিতে কষ্ট হয় না যে দেওয়ালে দেওয়ালে যে আর্তবিলাপ আরম্ভ হইয়াছে, সে শুধু বাতাসের কান্না নয়, ওর মধ্যে মিশিযা আছে প্রত্যেকটি ইটের মুক্তি পাইবার শান্দিত ব্যাকুলতা। দিয়াশলাই খুজিয়া লইয়া কম্পিতহস্তে অনন্ত একটা কাঠি জ্বলিল। দুয়ারের অবস্থান দেখিযা লইয়া কাঠিটা ষ্টুড়িয়া ফেলিয়া সে চৌকি হইতে নামিয়া পড়ে। দরজাব বাহিরে পাগলা হাওয়া বারিকণা লইয়া যে খেলা খেলিতেছিল। তাহার বর্ণনা হয় না। সমস্ত অন্ধকার যেন সে উন্মত্ত খেলায় আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছে। এমন ঝড়-বাদল অনন্ত জীবনে আর দেখে নাই। পায়ে ভর দিয়া দাঁড়ানো অবধি বুকের ভিতর আবার অসহ্য যন্ত্রণা হইতেছিল, দেওয়াল ধরিযা ধরিয়া অনন্ত অতিকষ্টে আগাইয়া যায়। মাঝে একখানা ঘরের পরেই কেতকীর ঘর-এই সামান্য দূরত্বটুকু যেন আর অতিক্রম করা যায় না। অনন্ত সজোরে দাঁতে দাঁত কামড়াইয়া ধরে। অবশেষে কেতকীর দরজাটা হাতে ঠেকে। বিদ্যুৎ ক্ৰমাগতই চমকাইতেছিল, অনন্ত লক্ষ করে বাহির হইতে দরজায় শিকল তোলা রহিয়াছে। পতনোমুখ গৃহ ত্যাগ করিয়া কেতকী মন্দিরে গিয়া আশ্রয় লইয়াছে—এ কথা ভাবিয়া প্রথমটা অনন্ত পরম স্বস্তি বোধ করে। কেতকী ঘুমাইয়া থাকিলে চারিদিকের এই প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে তাহাকে ডাকিয়া তোলা সহজ হইত না। দরজায ধাক্কা দিয়া লাভ ছিল না, বাতাস বহূক্ষণ ধরিয়া বীরবিক্ৰমে সে কাজ করিতেছে। নিজের কানে পৌঁছবার মতো শব্দও বোধ হয় তাহার ফুসফুসে এখন নাই। কিন্তু যেমন কবিয়াই হোক কেতকীকে ডাকিয়া তুলিতে হইবে ;---এই ঝড়ে এখানে থাকা অসম্ভব। আপনা হইতে নিরাপদ আশ্রয় খুজিয়া নিয়া সে ভালোই করিয়াছে { কিন্তু তাহাকে একবার না ডাকিয়াই কেতকী চলিয়া গেল? ঝড়ের সম্ভাবনা দেখিযা সন্ধ্যাবেলা ঠাকুর-চাকরের সঙ্গে তাহাকে গ্রামে পঠাইয়া দিবার জন্য যে আমন ব্যাকুল হইয়াছিল ? অনন্ত শিকল খুলিয়া ফেলে। বাতাসের ধাক্কায় দুই পাট দরজা আছড়াইয়া খুলিয়া যায়। ঘরেব কোণে আলো জ্বলিতেছিল, বাতাসে নিভিয়া যায নাই। অনন্ত দেখিতে পায় আগাগোড়া চাদর মুডি দিযা কেতকী বোধ হয নিরুদবেগে ঘুমাইয়াই আছে, আড়াআড়িভাবে তাহার বুকের উপর পডিয়া আছে একটা স্থল কড়িকাঠ। ভিতর হইতে দরজা খুলিয়া রাখিযা কেতকী যে এমনভাবে ঘুমাইয়া পড়ে নাই বুঝিতে অনন্তর কষ্ট হয় না। অনেক টানাটানি করিয়াও বাহির হইতে শিকল লাগানো দুয়ারটা যখন সে খুলিতে পাবে নাই, তখনই এ ভাবে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইয়াছে। কাছে গিয়া অনন্ত দুই হাতে কড়িকাঠটা ধরিয়া টানিতে আরম্ভ করিয়া দেয়। সকালে ঝড় কমে কিন্তু থামে না। রক্তবর্ণ চোখ মেলিয়া শঙ্কর বহুক্ষণ ইষ্টকস্তুপের নীচে অর্ধবৃত দেহাংশ দুটির দিকে চাহিয়া থাকে। তারপর একটা ভাঙা বুড়ি খুঁজিয়া নিয়া বুড়ি ঝুড়ি ইট আনিয়া ইটের ভূপে ফেলিতে থাকে। দেহ দুটিকে সে সম্পূর্ণরূপে ঢাকিয়া দিতে চায়। সমস্ত রাত্রি যে শয্যায়। ইহারা পরস্পরকে ভালোবাসিয়াছে অনন্তকাল সেই শয্যাতেই ইহারা ঘুমাইয়া থাক, শঙ্করের আপত্তি নাই। কিন্তু কেহ যেন না জানে । মানুষের মাটির দেহ মাটিতে পরিণত হইতে কত সময় নেয় ? শেষ বেলায় ইটের শেষ বুড়িটা তুলিতে না পারিয়া মাটিতে বসিয়া শঙ্কর তাহাঁই ভাবে। বৃষ্টিতে ভিজিতে ভিজিতে সে ঠকঠক করিয়া কঁপে। তাহাকে ঘিরিয়া থাকিয়া থাকিয়া বাতাস গর্জায়।