পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in অতসী মামি Ν. Ο ο কী করে যে মুখের ওপর পারব না বলিস বাছা বুঝতে পারি না। একে ওবি সর্দি, এই বাদলাতে ভাত খেয়ে যদি অসুখ করে ? ভাজতে না পারিস, ময়দাটা তো মাখতে পারবি, না তাও পারবি না ? কুসুম ময়দা মাখিয়া দিয়াছিল। মাখিতে মাখিতে তারকের অকালমৃত্যুর জন্য নিজেকে দৈনন্দিন হিসাবের চেয়ে একটু বেশি রকম দায়ি করিয়া ফেলিয়াছিল। শ্মশানের মূৰ্ছি ঘরে আসিযা ভাঙিবার পর যে আত্মগ্লানির জন্য সে কঁদে নাই এ সেই আত্মনির্যাতন। স্বামীকে দিয়া সিঁদুব আনাইতে নাই এটা কুসুম জানিত, আজকাল তার ধাৰণা হইয়াছে বিযুদিবারের বারবেলায় স্বামী মাথার তেল আনিয়া দিলেও অমঙ্গল হয। এ বিষযে কুসুমের যুক্তিও আছে। সিঁদুব পরে সধবা, তেলও সধবাই মাখে। দেবতার প্রসাদে তেল-সিঁদুরই সধবার সবচেয়ে কাম্য | এ বিষয়ে সে কিন্তু একেবারে নিঃসন্দেহ নয়। তারক আরও কয়েকবার তাহাকে তেল কিনিয়া দিয়াছে, কখনও তো কিছু হয় নাই। গৰম ঘিয়ে পা পুডিযা না গেলে তারকের যে অত জ্বর হইত না, ইহাতে কুসুম লেশমাত্ৰ সন্দেহ কবে না। ম্যালেরিয়া ও রকম হয় ? সে নিজে কত ম্যালেরিয়ায় ভূগি যাছে ম্যালেবিয়ায় মানুষ তিনদিনে মারা যায় না । তারপর তাবকেপ ভালো-মতো চিকিৎসাও হয় নাই। কোথা দিয়া কী হইয়া গেল, চিকিৎসাবি সময়ও যেন পাওয়া গেল না। পোস্টাপিসের টাকা জমানো বহিল, গায়ের গহনা বাধা পড়িল না, বডো বডো ডাক্তাবে বা তাবককে দেখাব সময়টা অবসরা-হিসাবে যাপন করিল। একটু নিরীহ দুর্বল প্রতিবাদ কবিয়াই সে হইল বিধবা । উনুনটা চমৎকাব জুলিতেছে, রান্নাঘরের এককোণে গেমা করিয়া রাখার দরুন। এই বাদলেও কাঠগুলো শুকনো খটখাটে হইযা আছে। পিড়িতে উবু হইয়া বসিয়া কুসুম মোহাবিষ্টার মতো আগুনের দিকে চাহিয়া বহিল। কী বং আগুনেব । কুসুম কতকাল দু-বেলা উনুন জ্বালাইযা রান্না করিয়াছে, এমন স্থল অগ্নিশিখায় এমন গাঢ় বঙেব আবির্ভাব সে কখনও দেখে নাই। তারকের চিতায়ও না। ওদিকে মামি লুচি ভাজিতেছিলেন, ঘিয়ের গন্ধে কুসুমের কষ্ট হইতে লাগিল। আগুনের অভূতপূর্ব বুপ সম্বন্ধে সম্পূৰ্ণ সচেতন থাকিয়াও ঘিয়ের গন্ধে সর্বাঙ্গে যে অস্বস্তিকর অণু,তুতি হইতেছিল। তাহাও সে উপলব্ধি কবিতে পাবিল। হঠাৎ বোমাঞ্চ হইয়া তার হাডের ভিতব পর্যন্ত শিরশির করিয়া উঠিল। কুসুম খুব বোগা হইয়া গিয়াছে। দেহে মনে সুস্থ থাকার পক্ষে তাব কতকগুলি গুরুতব অসুবিধা উপস্থিত হইয়াছে। কযেক মাসেব মধ্যে পৃথিবী তার কাছে আব্ব একটি মানুষ আদায় করিবেবৈধব্য-জীবনটা এ অবস্থায্য উপযোগী নয়, রাত্রে তাহার ভালো ঘুম হয় না। শোক, অন্ধকার, ঘুমন্ত খোকা আর খানিকটা পাগলামি আজকাল কুসুমের রাত্রির সম্পদ। শোক তাঁহাকে থাকিয়া থাকিয়া কঁদোয়, অন্ধকার তাহাকে ভয় দেখায়, খোকা তাহাকে বিরক্ত করে, আর পাগলামি তাহাকে জাগাইয়া রাখে। তাব পাগলামি এইরূপ। সে মনে কবে তারকের সঙ্গে গল্প করিয়া সে যত রাত জাগিত এখন তারকের জন্য শোক করিয়া তার চেয়ে ঢ়েব বেশি রাত জাগা উচিত। ঘুম আসিলেও সে তাই ঘুমায় না। ঘুমকে ঠেকানো তার পক্ষে কঠিন নয়। তারকের সোনার রং কেমন করিয়া পুড়িয়া কালো হইয়া ফোসক পড়িয়াছিল। সেই দৃশ্যটা কল্পনা করিলেই হইল। ঘুমের আর চিহ্নমাত্র থাকে না। মামির বড়ো মেয়ে বাটি নিয়ত আসিয়া বলিল, কত কাঠ গুজেছিস কুসুম ? একদিনে সব পুড়িয়ে শেষ করবি না কি ?