পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in SqO Sq মানিক রচনাসমগ্ৰ আনমনে গুজে ফেলেছি দিদি। কুসুম তিন-চারখানা কাঠ টানিয়া বাহির করিয়া জল ছিটাইযা নিবাইয়া উনুনের পাশে রাখিল। ধোঁয়ায় তার চোেখ কটকট করিয়া জল পড়িতে লাগিল। জ্বলন্ত কাঠ ভালো কবিয়া না নিবাইলে যেমন ধোঁয়া হয় তেমনি একটা বিশ্ৰী শ্মশান-আশ্রয়ী গন্ধ ছাড়ে। ধোঁয়ার ছলনায় নয়, প্রকাশ্যে এবং গোপনে কুসুম আজকাল খুব কঁাদে। তার চোখের জল জমাই যা রাখিলে একটা বাটি ভরিয়া যাইত। মুছিয়া মুছিযা চোখ শুকনো হইলে কুসুম চাহিয়া দেখিল ভাবী একটা বিপদের সূত্রপাত হইয়াছে। উনুনের পাশে এক আটটি পাটকাঠি বেড়ায় ঠেস দিয়া রাখা হইয়াছিল, ইতিমধ্যে কখন নেবানো কাঠগুলির একটা আপনা-আপনি জ্বলিফা উঠিযা তাহাতে আগুন ধরাইয়া দিয়াছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে এ আগুন বেড়ায় লাগিবে এবং দেখিতে দেখিতে খড়ের চাল জুলিয়া উঠিবে। বৃষ্টিতে চালোব উপরিভাগ অবশ্য ভিজিয়া আছে, কিন্তু আগুনকে ঠেকাইবার ক্ষমতা তাহার নাই। রান্নাঘবের চাল একবার জুলিয়া উঠিতে পারিলে বাড়ির অন্য ঘরগুলিকেও দলে টানিবে। পাশের মুখুজ্যে-বাডি বেহাই পাইবে না, সরকাবদের বাড়িটাও মুখুজোঁ-বাডিব লােগাও। পাটকাঠিগুলিব মধ্যে সদাজাগ্রত ওই ভীবু ও দ্বিধাগ্রস্ত শিশু অগ্নিদেবতাটি আজ পাড়ায় লঙ্কাকাণ্ড না করি যা ছাডিবে না। ব্যাপাবটা কুসুম চমৎকার কল্পনা করিতে পাবে। একটা বিরাট বিশ্বগ্রাসী চিন্তা---একবাত্রে একসঙ্গে একবাশি মানুষের সর্বনাশ! রঙে আর উত্তাপে অন্ধকার আর শূন্য ভরপুব হইযা যাওয়া এবং তাঁহারই চারিদিকে কেবল হায় হায়, কেবল বুক-চাপড়ানো! দুই চাবিজন পডিয়া মরিবে না? তীব্র তীক্ষদৃষ্টি মেলিযা কুসুম হিংস্র সাপের মতো অগ্নিশিখার হেলিয়া-দুলিযা বাডিয়া-কমিয়া শ্লথ সন্তৰ্পণ অগ্রগতি চাহিয়া দেখিতে লাগিল। ধীরে ধীবে আকার বাডিতেছে, হেলানো সূদীর্ঘ সমিধ বাহিয়া ধীব অনিবাৰ্য বেগে উপরে উঠিতেছে। ঘরে আজ নিশ্চয় আগুন লাগিবে। আর কেহ পুডিযা না মরুক, কুসুমের আজ উদ্ধার নাই। সে কিছুতেই পলাইতে পরিবে না। পিাড়ির সঙ্গে মাটির সঙ্গে সে একেবাবে আটিযা গিয়াছে, তাহার সর্বাঙ্গে পক্ষাঘাত হইয়াছে, সে অবশ, অবসন্ন। উঠিবার, নডিবাব, টানিয়া পাটকাঠিগুলি সরাইয়া আনিবাব শক্তিও তাহার নাই। সে পালাইবে কেমন কবি যা ? কুসুম স্পষ্ট দেখিতে পাইল, খড়ের জুলন্ত চালের নীচে চাপা পড়িয়া সে ছটফট করিতেছে, তার গায়ের চামডা কয়লাব মতো কালো হইয়া যাইতেছে আর সর্বাঙ্গে পড়িতেছে বড়ো বড়ো ফোসিকা। কাল্পনিক নৃত্যুর বীভৎসতাব আতঙ্কে কুসুম এক প্রকার উৎকট আনন্দ উপভোগ করিতে व्लाकिन। তাব আব্ব কিছুমাত্ৰ সংশয় রহিল না যে, একবার হাত বাড়াইলেই যে বিপদ আটকানো যায় সে-বিপদের সামনে সে যে হাত গুটািইয়া বসিয়া আছে সে বিধান ঈশ্বরের। ঈশ্বর তার বাড়াইবার শক্তি হরণ করিয়াছেন। সে সতী কী-না, বিলম্বিত সহমরণকে নিজেও তাই ঠেকাইতে পারিতেছে না। নিজে সে এ আয়োজন করিতে পারিত না। তার আত্মহত্যার মধ্যে শুধু আত্মহত্যার পাপ নয় নরহত্যার পাপিও আছে। কিন্তু ঘরে আগুন লাগিয়া পুড়িয়া মরাতে আর তার হােত কী? সে জন্য তাহাকে নরকে যাইতে হইবে না, কাহারও কাছে কোনো লৈফিয়ত দিতে হইবে না, হাসিতে হাসিতে সে স্বৰ্গে তারকের কাছে চলিয়া যাইবে। পয়ত্ৰিশ দিনের বেশি সে যে বিধবা হইয়া থাকিল না ইহার গৌরবে মুগ্ধ হইয়া লোকে ধন্য ধন্য করিবে।