পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Sobr মানিক রচনাসমগ্র মুখ রাঙা করিয়া মাসির দিকে ঝুঁকিয়া চাপাগলায় পটলি বলিল, আঃ, তুমি চুপ কর মাসি, আমার আজ প্ৰণাম করতে নেই। ‘অ!’ বলিয়া মাসি থ বনিয়া গেলেন। মুকুলও। এমনভাবেই তাহারা পর হইয়া গিয়াছে পরিবর্তনের মধ্যে। মুকুল বিমর্ষ হইয়া বসিয়া রহিল। বাড়িটাকে আজ ভারী চাপা, ভারী নোংরা মনে হইতেছে। ছোটাে উঠানে আলো বাতাস স্বচ্ছন্দে আসিতে পারে না, সমস্ত উঠানে কত কী আবর্জনা। চোকলা-তোলা মেঝেতে শ্বেতপাথরের স্বপ্নও নাই, দেয়ালগুলি বিবর্ণ ও উপরের দিকে ঝুলভরা, ঘরে ঢুকিলে মুকুলের নিশ্চয় নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিবে। মাসির বাতের মালিশের দুৰ্গন্ধটাই যেন এ বাড়ির আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়াছে, তার রুমালের সিংহলি আতরের গন্ধ অতিথির মতো, পরের মতো এখানে বেমানান! রান্নাঘরের জানালায় কালিবর্ণ শিকের ফঁাকে শশীমুখী উকি দিতেছিল, মুকুলের চােখ পড়া মাত্র তাহার ফরসা মুখ ডগডগে। লাল হইয়া যাইতেছে! এ আর এক কৌতুক। পাঁচ বছর আগে শশীমুখীর এই বারবার উকি দেওয়া আর মুখ লাল করার মধ্যে ভালোবাসার প্ৰকাণ্ড একটা প্রমাণ আবিষ্কার করিযা সে পুলকিত হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু আজ তাহার অভিজ্ঞতায় ইহার ফাঁকি ধরা পড়িয়া গিয়াছে। শশীমুখীর চাওয়া চোখে, লালিমা মুখে, মনে শুধু কৌতুহল আব লজা। স্বামীকেও চোখে সহাইয়া নিতেছে। এতকাল পরে কল্পনার বাহিরের দেশ হইতে লক্ষকোটি বিপদ-আপদের হাত এড়াইয়া যে স্বামী ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে একটিমাত্র ব্যাকুল দৃষ্টিপাতে সুস্থ দেখিয়া অক্ষত দেখিয়া আড়ালে গিয়া শশীমুখী ঝরঝর করিয়া কঁাদিয়া ফেলে নাই, ব্যগ্র উৎসুক চোখে কম্পিত সচেতন অঙ্গুলিতে স্বামীকে ভালো করিয়া দেখিবাব ও চিনিবাব সাধ নিরালার মিলন মুহূর্তটির জন্য তুলিয়া রাখে নাই, পথের বৈচিত্ৰ্য যেমন করিয়া দেখে তেমনিভাবে স্বামীকে দেখিতেছে, পাবপুরুষের দৃষ্টিপাতে যেমন করিয়া মুখ লাল করে তেমনিভাবে স্বামীর চাহনিতে রাঙা হইয়া উঠিতেছে। শশীমুখীর সম্বন্ধে মুকুল হতাশ হইযা গেল। বাউ ভালো হইলে নিজেকে কি এত সস্তা করিয়া দেয়? ও এমন ধৈর্যহীনা। এমন লোভাতুরা যে আগামী মিলনকে অখণ্ড রাখিতে পারিতেছে না, এখন হইতেই ভাঙিয়া ভাঙিয়া চাখিতে শুরু করিয়াছে। বিদেশে অন্যায় করিয়া আসার জন্যে মুকুলের হঠাৎ আর কোনো ক্ষোভ রহিল না। ইতিমধ্যে গলায় কাটা বিধিয়া বাসন্তীর ছেলে কান্না আরম্ভ করিয়াছিল, মাসির ছোটো মেয়েটােবও লঙ্কা চিবাইয়া ঝাল লাগিয়াছে। বাসন্তী আদর করিয়া শশীমুখীকে ডাকিয়া বলিল, মাছ বেছে বুলুকে একটু খাইয়ে দাও না বউদিভাই ! মুকুল শুনুক, বুকুক যে শশীমুখীর সঙ্গে সে বরাবর এমনি মধুর ব্যবহার করিয়াছে, কদাচ কলহ করে নাই। যদিই বা কখনও একটু কথা কাটাকাটি হইয়া থাকে। শশীমুখী কি আর সে কথা দাদার কানে তুলিবে? একসঙ্গে থাকিতে গেলে সংসারে অমন কত হয়! মাসি অত কারও খাতির করেন না। ওকে মাছ বেছে দিলেই হবে বউমা ? মেয়েটা এদিকে ঝাল খেয়ে সারা হয়ে গেল যে! বাসন্তী বলিল, বউদি। একহাতে কজনকে খাওয়াবে মাসি ? মাসি বলিলেন, তাই বলে মেয়েটা চেচিয়ে মরবো? ঝাল লাগলে জল পাবে না একটু ? বাসন্তী বলিল, ওই তো রয়েছে গোলাসে জল, খেলেই পারত।