পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in জননী S বারবার বুকে মালিশ করিয়া দিতে হইত। এমনই আরও কত কী। নাড়ি কাটিবার দোষেই সম্ভবত ছেলের নাভিমূল চার দিনের দিন পাকিয়া ফুলিয়া উঠিয়াছিল। শ্যামা নিজে এবং মন্দা ও বুড়ি দাই এই তিনজনে ক্ৰমাগত ছেলের নাভিতে সেঁক দিয়াছিল। দিনেব বেলাটা এক বকম কাটিয়া যাইত, শ্যামার ভয় করিত রাত্রে। পূর্বপুরুষদের আবির্ভাবের ভযা নয়, তঁাবা একদিনেব বেশি আসেন নাই,--অসম্ভব কাল্পনিক সব ভয় । শ্যামা যেন কার কাছে গল্প শুনিয়াছিল এক ঘুমকাতৃবে মার, ঘুমের ঘোরে যে একদিন আঁতুড়ে নিজের ছেলেকে চাপা দিয়া মারি যা ফেলিয়াছিল। নিজেল ঘুমন্ত অবস্থাকে শ্যামা বিশ্বাস করিতে পারিত না। নাকে মুখে পাতলা কাপড় এক মুহুর্তের জন্য চাপা পড়িলে যে ক্ষীণ অসহায় প্রাণীটি দম, আটকাইয়া মরিতে বসে, ঘুমের মধ্যে একখানা হাতও যদি সে তাহার উপরে তুলিয়া দেয় সে কি আর তবে বঁচিবে ? শ্যামা নিশ্চিন্ত হইযা ঘুমাইতে পাবিত না। পাশ ফিরিলেই ছেলেকে পিষিয়া ফেলিয়াছে ভাবিয়া চমকিয়া জাগিয়া যাইত। কান পাতিয়া সে ছেলে নিশ্বাসের শব্দ শুনিতে চেষ্টা করিত। মনে হইত, নিশ্বাস যেন পড়িতেছে। কানকে বিশ্বাস করিয়া। তবু সে নিশ্চিন্ত হইতে পারিত না। মাথা উঁচু করিয়া ছেলেকে দেখিত, নাকের নীচে গাল পাতিয়া নিশ্বাসের স্পর্শ অনুভব করিত। তারপর ছেলের বুকে হাত রাখিয়া স্পন্দন গুনিত-- ধুকধুক ! হঠাৎ তাহার নিজেব তৃৎপিণ্ড সজোরে স্পন্দিত হইয়া উঠিত। এ কী! ছেলের কুৎস্পন্দন যেন মৃদু হ2য় ৩০সিয়াছে। নিশীথ স্তব্ধতায় এই আশঙ্কা শ্যামাকে পাইয়া বসিত। সে যেন বিশ্বাস করিতে পারিত না যে | এতটুকু একটা জীব নিজস্ব জীবনীশক্তির জোরে ঘণ্টাব পাব ঘণ্টা বঁচিয়া থাকিতে পারে। শ্যামার কেবলই মনে হইত, এই বুঝি দুর্বল কলকবজাগুলো থামিয়া গেল। পৃথিবীব সমস্ত মানুষ একদিন এমনই ছিল দিনের বেলা এ যুক্তি শ্যামাব কাজে লাগিত, রাত্রে তাহার চিন্তাধারা কোনো যুক্তির বালাই মানিত না, ভযে ভাবনাযা সে আকুল হইয়া থাকিত। সৃষ্টিব্য রহস্যময় স্রোতে যে ভাসিয়া আসিয়াছে নিঃ নির্বিকাব রাত্ৰিল অজানা বিপদেব কোলে সে মিশিয়া যাইবে, শ্যামার ইহা স্বতঃসিদ্ধের মতো মনে হইত। ছেলে কোলে সে জাগিয়া বসিয়া থাকিত। দুর্বলতায় তাহার মাথা ঝিমঝিম করিত। প্রত্যাহত নিদ্রা চোখের সামনে নাচাইত ছযা। প্রদীপের নিষ্কম্প শিখটি তাহাকে আr - যা দিত, ভরসা দিত না। এই আশঙ্কা ও দুর্ভাবনার ভাগ শ্যামা কাহাকেও দিত না। ভাগ লইবার কেহ ছিলও না। এক ছিল শীতল, আঁতুড়ের ধারে কাছেও সে ভিড়িত না। ষষ্ঠীপূজার রাত্রে সে কেবল একবার নেশােব আবেশে কী মনে করিয়া আঁতুড়ে ঢুকিয়াছিল। ছেলের শিয়রের কাছে ধপাস কবিয়া বসিয়া পডিয়াছিল এবং অকারণে হাসিয়াছিল। শ্যামা বলিয়াছিল, তুমি কী গো ? বিছানা ছুঁয়ে দিলে ? শীতল বলিয়াছিল, খোকাকে একটু কোলে নিই!! ...বলিয়া ছেলের বগলের নীচে হাত দিয়া তুলিতে গিয়াছিল। শ্যামা ঝটিকা দিয়া তাহার হাত সরাইয়া দিয়া বলিয়াছিল কী করা ? ঘাড় ভেঙে যাবে যে ? ঘাড় শক্ত হয়নি ? নাকে গন্ধ লাগায় এতক্ষণে শ্যামা টের পাইয় দিল। গিলেছ বুঝি ? তুমি যাও বাবু এখান থেকে, যাও। নেশা কবিলে শীতলের মেজাজ জল হইযা করুণ রসে মন থমথম করে। সে ছলছল চোখে বলিয়াছিল, আর করব না। শ্যামা। যদি করি তো খোকার মাথা খাই! শ্যামা বলিয়াছিল, কথােব কী ছিরি। যাও না বাবু এখান থেকে ? শীতল বড়ো দমিয়া গিয়াছিল। যেন কঁাদিয়াই ফেলিবে। খানিক পরে শ্যামার বালিশটাকে শোনাইয়া বলিয়াছিল, একবার কোলে নেব না বুঝি!